বিমূর্ত বীজগণিতের অন্যতম স্রষ্টা এমি নোয়েথারের জীবনসংগ্রাম

. Wednesday, November 5, 2008
  • Agregar a Technorati
  • Agregar a Del.icio.us
  • Agregar a DiggIt!
  • Agregar a Yahoo!
  • Agregar a Google
  • Agregar a Meneame
  • Agregar a Furl
  • Agregar a Reddit
  • Agregar a Magnolia
  • Agregar a Blinklist
  • Agregar a Blogmarks

এ এম হারুন অর রশীদ ও ফরিদা হক
গত সংখ্যার পর
গণিতজ্ঞ বাবার উৎসাহ ও সাহচর্য যে এমির জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছিল, তা বলাই বাহুল্য। বাবা ও মেয়ের এই বৈজ্ঞানিক সহযোগিতা গণিতের ইতিহাসে একটি মধুর অধ্যায়। হেরমান ভাইলের ভাষায়, ‘বাবা ও মেয়ের এই অপূর্ব সাহচর্য সৃষ্টি করেছিল এক সৃষ্টিশীল ও সক্রিয় জুটি, যা গণিতের জগতে তুলনাহীন।’

এমি নোয়েথার ঠিক কী ধরনের কাজ করে বিখ্যাত হয়েছিলেন, তা এখানে সামান্য উত্থাপন করাও অসম্ভব−ব্যাখ্যা করা তো দুরের কথা। কিন্তু কিছু ধারণা দেওয়ার জন্য উল্লেখ করা যায়, এমি ছিলেন একজন বিশুদ্ধ বীজগণিতবিদ। একজন বিশুদ্ধ গণিতবিদ সংখ্যার ওপর চারটি কাজ বা অপারেশন ছাড়া আর কিছুই করতে পারেন না। কাজগুলো হলো যোগ, বিয়োগ, গুণ ও ভাগ। তাঁর কাছে সংখ্যার একটি গুচ্ছ আসলে একটি আবদ্ধ গুচ্ছ; অর্থাৎ তাঁর কাছে এমন কিছুই নেই, যা দিয়ে তিনি ওই গুচ্ছের বাইরে যেতে পারেন। এ ধরনের একটি সংখ্যাগুচ্ছকে বলে ক্ষেত্র বা ফিল্ড। ক্ষেত্রের সবচেয়ে সহজ উদাহরণ হলো মূলদ সংখ্যার সেট। এখন আমরা সবাই জানি, বীজগণিতের চিরায়ত সমস্যা হলো বীজগাণিতিক সমীকরণ f(x)=0 এর সমাধান নির্ধারণ, যেখানে x হলো একটি চলক রাশি এবং f(x) হলো তার অপেক্ষক। এখন অপেক্ষকের মধ্যে থাকে চলকের বিভিন্ন ঘাতের পদ, যাদের সহগগুলো তৈরি করে একটা ক্ষেত্র বা ফিল্ড শ। উদাহরণস্বরূপ মূলদ সংখ্যার ক্ষেত্রে এর মধ্যেই সীমিত থাকে ওই অপেক্ষকের সব সহগ। এখন বীজগাণিতিক সমীকরণটি সমাধান করে আমরা পাই তার মূল, যা জানা থাকলে সৃষ্টি করা যায় উপরিউক্ত চারটি কাজের মাধ্যমে একটি বীজগাণিতিক ক্ষেত্র k ("")।

পূর্ণ সংখ্যার ওপর শুধু যোগ, বিয়োগ ও গুণন আমরা অসংখ্যবার প্রয়োগ করতে পারি। এভাবে সংখ্যার যে এলাকা বা অঞ্চল সৃষ্টি হয়, তাকে বলে রিং। সংখ্যাতত্ত্ব আলোচনা করে এই রিং নিয়ে; ফিল্ড নিয়ে নয়। একটি চলকের অপেক্ষক হলো একটি বহুপদী রাশি বা পলিনমিয়াল, যা সেই সব রাশির অঞ্চল চিহ্নিত করে, যাদের মাধ্যমে একটা রিং তৈরি হয়। সুতরাং বহুপদীর সংশ্লিষ্ট বীজগণিতের রাশি হলো রিং। এভাবে স্বতঃসিদ্ধ পদ্ধতিতে ধীরে ধীরে একটা বীজগাণিতিক সংগঠন তৈরি করা যায়। এই স্বতঃসিদ্ধ বীজগণিতের সঙ্গে জড়িত বিখ্যাত সব গণিতবিদের নাম; যেমন−ক্রোনোকার, ডোডেফিল্ড, মূর, পিয়ানো ও হিলবার্ট, যাঁদের হাতে স্বতঃসিদ্ধ পদ্ধতি সৃষ্টি এবং বিকাশ লাভ করে। এমি নোয়েথারও ছিলেন এই স্বতঃসিদ্ধ গণিতের একজন অত্যন্ত নিপুণ ও সার্থক শিল্পী। তাঁর হাতেই গণিতের বহু নতুন সমস্যা চিহ্নিত ও সমাধান হয়েছে। এভাবেই সৃষ্টি হয়েছে অবিনিময়ী বীজগণিত, যার প্রয়োগ আমরা পাই আজকাল কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানে এবং কণা-পদার্থবিজ্ঞানে।

এমি নোয়েথারের কর্মপরিমন্ডলের পূর্ণ পরিচয় দেওয়ার স্থান এটা নয়। তবে এটুকু বলা যায়, তিনি ১৯১৩ সালে কাজ করেছিলেন যৌক্তিক অপেক্ষকের ওপর, ১৯২০ সালে মডিউল, আইডিয়ালের ওপর এবং ১৯২৫ সালে গ্রুপতত্ত্বের ওপর। কোয়ান্টাম ক্ষেত্রতত্ত্বের প্রথমেই আসে ‘নোয়েথারের উপপাদ্যে’র উল্লেখ। এ উপপাদ্য অনুসারে যেকোনো ভৌত ব্যবস্থার প্রতিসাম্য গাণিতিকভাবে প্রকাশ করার জন্য প্রয়োজন হয় কতগুলো কারকের। ভৌত প্রতিসাম্যের অধীনে ওই কারকগুলো যদি অপরিবর্তনীয় থাকে, তবে তার অনুষঙ্গী একটি সংরক্ষণের আইনও আমরা স্বীকার করে নিই। যেমন−ত্রিমাত্রিক বিশ্বের মহাকাশ সব দিকে একই। তাই এই বিশ্বে সরণ প্রতিসাম্য দাবি করে সর্বব্যাপী রৈখিক ভরবেগের সংরক্ষণের নীতি। একইভাবে সময় অনুসারে সরণের অনুষঙ্গী কারকের অপরিবর্তনের দাবি থেকে আসে শক্তি সংরক্ষণের নীতি। এভাবেই শক্তি ও ভরবেগের সংরক্ষণের নীতি নোয়েথারের তত্ত্বের মাধ্যমে তাদের প্রকৃত কারণ অর্থাৎ মহাকাশের দিক-নিরপেক্ষতার প্রতিসাম্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে যায়। এমি নোয়েথার প্রথম জীবনেই অপরিবর্তনীয়ের নীতির একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন। ফলে গটিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত অধ্যাপক ক্লাইন ও হিলবার্ট তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রণ করে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, জার্মান গণিতের এত বড় দুজন ব্যক্তিত্বের পক্ষেও এমিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি উপযুক্ত নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছিল একটি আইন−বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পদে নিয়োগ লাভ করতে পারেন পুরুষ, কোনো মহিলা নন। হিলবার্ট তাই এ সময় প্রকাশ্যে দুঃখ করে বলেছিলেন, তিনি বুঝতে পারেন না যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার ক্ষেত্রে এ প্রশ্ন কেন ওঠে, প্রার্থী পুরুষ না মহিলা; বিশ্ববিদ্যালয় তো স্নানাগার নয়? অবশ্য এমির দুর্ভাগ্য ছিল দ্বিবিধ−তিনি ছিলেন মহিলা ও ইহুদি। তবে নোয়েথারের অকৃত্রিম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন হিলবার্ট, ক্লাইন, আইনস্টাইন, ডাইল এবং আরও অসংখ্য প্রথিতযশা বিজ্ঞানী। কিন্তু জাতিগত বিদ্বেষ ও ঈর্ষাপরায়ণতা যে ছিল না, তা নয়। কিছুকাল তিনি অতি সাধারণ একটি নিয়োগ পেয়েছিলেন, যার জন্য কোনো বেতন নির্দিষ্ট ছিল না। জার্মান ভাষায় এটা ছিল ‘টিটেল ওহনে মিটেল’, সম্মানী ছাড়া শুধু উপাধি। কিন্তু সেটাও একসময় বন্ধ হয়ে যায়, নাৎসিরা যখন রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে ইহুদি বিতাড়ন এবং পরে ইহুদি নিধন শুরু করে। এমি নোয়েথারের পক্ষে জার্মানি থেকে পালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া ছাড়া আর উপায় ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রে তিনি এক মহিলা কলেজে একটি সম্মানজনক পদ পান। কিন্তু অবিবাহিত এমি নোয়েথারের জীবনধারণের চাহিদা ছিল অতি সামান্য। তাই তিনি তাঁর নতুন বেতনের অর্ধেকই তাঁর ভ্রাতুষ্কপুত্রের জন্য সঞ্চয় করে রাখতেন। এমি নোয়েথার সম্পর্কে যে গল্পটি আমার সবচেয়ে মধুর লাগে, তা হলো তাঁর ছাতার গল্প। তাঁর বহুল ব্যবহূত ছাতার দুরবস্থা দেখে তাঁর ছাত্রছাত্রীরা একবার সেটি মেরামত করার প্রস্তাব করলে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘তা তো সম্ভব নয়। যখন বৃষ্টি হয় না, তখন আমি ছাতার কথা চিন্তাই করি না। কিন্তু যখন বৃষ্টি পড়ে, তখন ছাতাটি আমি ব্যবহারই করি।’ বোধহয় এ কারণেই নোয়েথারের সব ছাত্রছাত্রী তাঁকে সব সময় গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সঙ্গে স্মরণ করতেন। এ জন্যই আলবার্ট আইনস্টাইন লিখেছিলেন, ‘এমি নোয়েথারের বহু বর্ষব্যাপী নিঃস্বার্থ, গভীর তাৎপর্যপূর্ণ গবেষণা জার্মানির নতুন শাসকেরা পুরস্কৃত করেছিলেন তাঁকে চাকরিচ্যুত করে, যে চাকরি ছিল তাঁর অতি সাধারণ জীবনধারণের একমাত্র উপায় এবং যার মাধ্যমে তিনি তাঁর গাণিতিক গবেষণাকর্ম চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। প্রিন্সটনে তিনি সেই সব সহকর্মীর সাহচর্য পেয়েছিলেন, যাঁরা তাঁর মৃত্যুর দিনটি পর্যন্ত তাঁর বন্ধুত্বের যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করেছিলেন। এটাই ছিল তাঁর সারা জীবনের সবচেয়ে সার্থক ও আনন্দময় কিছু সময়।

প্রথম আলো, ২ অক্টোবর, ২০০৮

0 comments: