বিমূর্ত বীজগণিতের অন্যতম স্রষ্টা এমি নোয়েথারের জীবনসংগ্রাম

. Sunday, October 26, 2008
  • Agregar a Technorati
  • Agregar a Del.icio.us
  • Agregar a DiggIt!
  • Agregar a Yahoo!
  • Agregar a Google
  • Agregar a Meneame
  • Agregar a Furl
  • Agregar a Reddit
  • Agregar a Magnolia
  • Agregar a Blinklist
  • Agregar a Blogmarks

এ এম হারুন অর রশীদ ও ফরিদা হক

উন্নত অথবা স্বল্পোন্নত−সব সমাজেই সংখ্যালগিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর কোনো সদস্য যদি মহিলা হন, তাহলে তিনি যত প্রতিভাধরই হোন না কেন, তাঁর পক্ষে বৃহত্তর সমাজের কাছ থেকে যথাযোগ্য স্বীকৃতি আশা করা অনেকটা আকাশকুসুম। এর একটা সুন্দর উদাহরণ আমালি এমি নোয়েথার (১৮৮২−১৯৩২), যিনি একদিকে মহিলা ও ইহুদি, অন্যদিকে নিঃসন্দেহে ঊনবিংশ শতাব্দীতে জন্মগ্রহণকারী প্রথম শ্রেণীর গণিতবিদদের অন্যতম উজ্জ্বল এক নক্ষত্র। তাঁর সম্পর্কে স্বয়ং অ্যালবার্ট আইনস্টাইন লিখেছিলেন, ‘জীবিত ও সক্রিয় বেশির ভাগ নামকরা গণিতজ্ঞের বিচারে ফ্রয়লাইন নোয়েথার ছিলেন মহিলাদের জন্য উচ্চশিক্ষা প্রবর্তনের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত জন্মগ্রহণকারী প্রতিভাশালী গণিতবিদদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গণিত-প্রতিভা।’

আইনস্টাইন যে মহিলার প্রয়াণকালে এই অকুন্ঠ প্রশংসাবাণী উচ্চারণ করেছিলেন, তিনি জার্মানির এরলাঙ্গেন শহরে ১৮৮২ সালের ২৩ মার্চ সোমবার জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ম্যাক্স নোয়েথার (১৮৪৪−১৯২১) নিজেও ছিলেন একজন নামকরা গণিতবিদ এবং এরলাঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক। ওই সময় এরলাঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয় ছিল জার্মানির তিনটি ‘মুক্ত’ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি। এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছিল এই অর্থে মুক্ত যে তারা খ্রিষ্টীয় চার্চের কোনো অর্থানুকুল্যে স্থাপিত হয়নি এবং তাই তারা ধর্মীয় বিধিনিষেধের বাইরে কাজ করার স্বাধীনতা বহুলাংশে ভোগ করত।

এরলাঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয় একসময় ইউরোপে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিল যে গণিতবিদের কল্যাণে, তিনি হলেন ফেলিক্স ক্লাইন (১৮৪৯−১৯২৫)। এই ফেলিক্স ক্লাইনই সর্বপ্রথম জ্যামিতিক গবেষণায় গ্রুপ বা দলের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফলে উদ্ভব হয়েছিল বিখ্যাত ক্লাইন-বোতলের। গণিতে ক্লাইনের গভীর অন্তর্দৃষ্টির ফলেই সৃষ্টি হয়েছিল তার ‘এরলাঙ্গেন প্রোগ্রাম’ বা এরলাঙ্গেন কর্মসুচি, যার জন্য আজও ক্লাইনের নাম গণিত মহলে শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়।

ফেলিক্স ক্লাইনের সুযোগ্য ছাত্র ছিলেন পল গর্ডান (১৮৩৭−১৯১২), যিনি শুধু ম্যাক্স নোয়েথারের বন্ধু ও সহকর্মীই ছিলেন না, তিনি মেয়ে এমি নোয়েথারের গবেষণা-পরিচালকও হয়ে গিয়েছিলেন। গর্ডানের প্রত্যক্ষ প্রভাবেই এমি নোয়েথার অপরিবর্তনীয়ের তত্ত্ব বা ‘থিওরি অব ইনভেরিয়্যান্টস’-এর ওপর একটি উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন জীবনের শুরুতেই। এ প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘টারনারি বাইকোয়াড্রাটিক ফর্মের ফর্ম ব্যবস্থা নির্মাণ’। এটাই এমি নোয়েথারের পিএইচডি অভিসন্দর্ভ, যা এরলাঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিবন্ধিত হয়েছিল ১৯০৮ সালের ২ জুলাই, যখন এমির বয়স মোটে ২৬। এর কিছুদিন আগেই এরলাঙ্গেনের পদার্থবিজ্ঞানী ও চিকিৎসকদের সমিতির এক সভার প্রতিবেদন হিসেবে প্রবন্ধটির অংশবিশেষ প্রকাশিত হয়েছিল। খুব সম্ভব এটাই এমি নোয়েথারের প্রথম বৈজ্ঞানিক প্রকাশনা, যা পরে সম্পুর্ণ আকারে প্রকাশিত হয়েছিল ‘জার্নাল ফ্যুর ডি রাইনে উন্ড আনগেভান্টে ম্যাথমেটিকে’, ১৩৪ (১৯০৮), ২৩-৯০। এই প্রবন্ধ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এ কারণে যে এ প্রবন্ধটি শেষ হয় একটি বিরাট তালিকা দিয়ে, যেখানে রয়েছে তিন শতাধিক বিস্তৃতভাবে লেখা অপরিবর্তনীয় রাশি। এসব রাশির কয়েকটি পরে আলোচনা করা হবে।

কিন্তু মজার ব্যাপার এই যে এমি নোয়েথার পরে তাঁর অপরিবর্তনীয়ের তত্ত্বের ওপর এ কাজ সম্পর্কে বিশেষ কিছু বলতে চাইতেন না। এমনকি তিনি একবার স্বীকারও করেছিলেন, ‘আমি সম্পুর্ণ ভুলেই গেছি প্রতীক গণনা পদ্ধতি, যা একসময় আমি শিখেছিলাম এবং ব্যবহার করেছিলাম।’ এমি নোয়েথার তাঁর পিএইচডির মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন সম্মানের সঙ্গেই−সুম্মা কাম লাউডে ১৯০৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর। এর পরের কয়েক বছর তিনি এরলাঙ্গেনের গণিত ইনস্টিটিউটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন কোনো বেতন বা নিয়োগ ছাড়াই। মনে হয়, এ সময়ই এটি এমির কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে তিনি তাঁর সমগ্র জীবন গণিতের গবেষণাতেই কাটিয়ে দেবেন−বেতন তাঁর ভাগ্যে আসুক বা না আসুক। এ সময় তিনি বিভিন্ন গাণিতিক সভা-সমিতি-আলোচনাচক্রে যোগদান করতেন উৎসাহের সঙ্গে। কেননা, এভাবেই গণিতে কী হচ্ছে, সে সম্পর্কে ধারণা করা যায়। এসব আলোচনাচক্রে অনেক সময় তিনিই একমাত্র মহিলা গণিতবিদ উপস্থিত থাকতেন; অন্য যেসব মহিলা আসতেন, তাঁরা তাঁদের স্বামীর সঙ্গিনী মাত্র।

মনে রাখা দরকার, এমি যখন জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তার কিছুদিন আগেও ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে মহিলাদের প্রবেশাধিকার ছিল না এবং জার্মানিতে কোনো বাবা চিন্তাও করতে পারতেন না, তাঁর মেয়ে বিজ্ঞান চর্চা করতে এগিয়ে আসবে, বিশেষ করে গণিতের মতো বিমূর্ত বিষয়ে। অবশ্য ১৯০৩ সালে মেরি কুরি পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্ককারের জন্য। মাদাম কুরি কী অমানুষিক পরিশ্রম করে খনিজ পদার্থ থেকে তেজস্ক্রিয় রেডিয়াম পৃথক করতে সক্ষম হয়েছিলেন, সে গল্প আজ সবাই জানে। মাদাম কুরি ভাগ্যবান যে তিনি তাঁর কাজের স্বীকৃতি পেয়েছিলেন, কিন্তু সবারই সে ভাগ্য হয় না। যেমন−পরমাণু বিভাজনের কথাটি প্রথমে যাঁর মাথায় এসেছিল, তিনি একজন জার্মান মহিলা−লিঙ্গে মাইটনার। আবার ডিএনএ পরমাণুর ডবল হেলিক্স নকশা যেসব পরীক্ষণলব্ধ প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল, এর এক্স-রে ছবিগুলো উঠিয়েছিলেন মিস রোজালিন্ড, যাঁর নামও আজ আর বিশেষ উচ্চারিত হয় না। কিন্তু গবেষণার পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয় জেনেও এরলাঙ্গেনের এই ইহুদি তরুণী সে পথই বেছে নিয়েছিলেন। পরে এমি নোয়েথার স্বতঃসিদ্ধ বীজগাণিতিক গবেষণার একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টিশীল গণিতবিদ হিসেবেই স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন। এটা যে একজন মহিলার পক্ষে কত বড় কৃতিত্ব, তা যাঁরা গণিত গবেষণার ব্যাপারে কিছু খোঁজখবর রাখেন, তাঁরাই স্বীকার করবেন।

প্রথম আলো, ২৬ অক্টোবর, বিজ্ঞান প্রজন্ম সংখ্যায় প্রকাশিত

1 comments:

Anonymous said...

ভালো উদ্যোগ। এগিয়ে চলুন।