কাজী মোতাহার হোসেন বিজ্ঞানচেতনার আলোকে

. Friday, July 31, 2009
  • Agregar a Technorati
  • Agregar a Del.icio.us
  • Agregar a DiggIt!
  • Agregar a Yahoo!
  • Agregar a Google
  • Agregar a Meneame
  • Agregar a Furl
  • Agregar a Reddit
  • Agregar a Magnolia
  • Agregar a Blinklist
  • Agregar a Blogmarks

আজকের যুগান্তর পত্রিকায় প্রখ্যাত দার্শনিক 'কাজী মোতাহার হোসেন'কে বিজ্ঞানচেতনার আলোকে সুন্দরভাবে আলোচনা করেছেন আবুল আহসান চৌধুরী। আলোচনাটি আমার ব্লগে রেখে দিলাম।  এরকম গুরুত্বপূর্ণ একটি লেখা প্রকাশের জন্য যুগান্তর পত্রিকার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

কাজী মোতাহার হোসেন বিজ্ঞানচেতনার আলোকে
আ বু ল আ হ সা ন চৌ ধু রী
মোতাহার হোসেন ছিলেন বুদ্ধির মুক্তি-আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা। ১৯২৬-এ ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় মুক্তবুদ্ধি-চর্চার প্রতিষ্ঠান ‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজ’। এই সংগঠনের বীজমন্ত্র ছিল- ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি যেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব;। সংস্কারমুক্ত, যুক্তিবাদী, প্রগতিশীল, কল্যাণমুখী সমাজগঠনই ছিল এর লক্ষ্য।

কাজী মোতাহার হোসেন (১৮৯৭-১৯৮১) তাঁর এক স্মৃতিচর্চায় নিজের যথার্থ পরিচয় কোনটি সে বিষয়ে বলতে গিয়ে কিছুটা কৌতুক করে প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘আমার সম্বন্ধে কথা উঠেছে, আমি দাবাড়ু, না বৈজ্ঞানিক, না সাহিত্যিক?’১ - এই প্রশ্নের জবাবে অনায়াসে বলা যায়, মোতাহার হোসেনের সব ক’টি পরিচয়েই বিখ্যাত ও বিশিষ্ট। এইসব গুণের যে-কোনো একটিকে অবলম্বন করেই তিনি জাতীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী হতে পারতেন। তবে দাবাড়ু ও সাহিত্যিক খ্যাতির কাছে তাঁর বিজ্ঞানসাধকের পরিচয়টি যে কিছুটা প্রচ্ছন্ন- এ-কথা অবশ্য কবুল করতেই হয়।

২.
কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন বিজ্ঞানের ছাত্র ও শিক্ষক। তাই তাঁর চিন্তা-চেতনার একটা বড়ো অংশ জুড়ে ছিল বিজ্ঞান। তবে বিজ্ঞান নিছকই তাঁর পেশাগত পঠন-পাঠনের বিষয় ছিল না। অধ্যয়ন-অধ্যাপনার সূত্রে বিজ্ঞান বিষয়ে তাঁর সন্ধিৎসা-কৌতূহল ও মৌলিক চিন্তাও ছিল। বিজ্ঞানকে তিনি নিছক যুক্তি-প্রমাণের প্রণালীবদ্ধ শৃঙ্খলা-শাস্ত্র বিবেচনা করেননি- তিনি একে দিয়েছিলেন সৃষ্টিশীল শাস্ত্রের মর্যাদা। তাই তাঁর মন-মনন-মানসের স্বরুপ সন্ধানের জন্যে তাঁর বিজ্ঞানচর্চা ও চিন্তার বিষয়টি বিবেচনা বিশেষ জরুরি।

৩.
মোতাহার হোসেন তাঁর বিজ্ঞানদৃষ্টি ও চেতনার জন্য জ্যোতীন্দ্রমোহন রায়, ডব্লিউ. এ. জেনকিন্স, সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশের কাছে গভীরভাবে ঋণী। জ্যোতীন্দ্রমোহন ছিলেন তাঁর স্কুলজীবনের শিক্ষক, জেনকিন্স কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষক, সত্যেন্দ্রনাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-সহকর্মী ও প্রশান্তচন্দ্র তাঁর পরিসংখ্যান-বিদ্যার গুরু।
তবে এ-বিষয়ে তাঁর সলতে-পাকানোর কাজটি হয়েছিল ছেলেবেলাতেই। বাল্য-পাঠের কালে তাঁর গাণিতিক-বিদ্যার হাতেখড়ি হয়েছিল খেলার ছলে এবং তার মূলে ছিল তাঁর পিতার আন্তরিক প্রয়াস। তিনি স্মরণ করেছেন :
তিনি [মোতাহার হোসেনের পিতা] যে ৮ বছর পর্যন্ত খেলাধুলার মাধ্যমে বাগানের ফুল-আম-জাম-পেয়ারা কুড়ানো আর বয়স্যদের সঙ্গে ভাগ-বাটোয়ারার মাধ্যমেই আমার স্বাভাবিক বুদ্ধিবিকাশের সুযোগ দিয়েছিলেন, সে জন্য আমি তাঁর প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা বোধ করি। সম্ভবত আমার অঙ্কের জ্ঞান অর্থাৎ স্কুলের যোগ-বিয়োগ, গুণ-ভাগের প্রয়োগ পদ্ধতির সঙ্গে মনের ভিতরে সঞ্চিত হয়েছিল। তাই শতকিয়া পাঠ, ধারাপাত, সংখ্যা-লিখন পদ্ধতি, ডাক পড়ানো ইত্যাদি কাজ আমার খুব ভাল লাগতো।২
সেই ছেলেবেলাতেই তাঁর উদ্ভাবনী শক্তি জন্ম নিয়েছিল। গ্রামের স্কুলের শিক্ষক তাঁকে ‘যোগ-বিয়োগ ও গুণনের পদ্ধতি শিখিয়েছিলেন’, তারপর ভাগের নিয়ম তিনি ‘নিজে নিজেই আবিষ্কার করে’ শিক্ষককে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। পরে যখন তিনি কুষ্টিয়া হাইস্কুলের ছাত্র, তখন যন্ত্র ও কলকবজার প্রতি কৌতূহলের কারণে একবার কেমন বিপত্তিতে পড়েছিলেন সে-কথা জানা যায় তাঁর স্কুলজীবনের স্মৃতিকথায় :
আমি একদিন [কুষ্টিয়া] রেল স্টেশনের স্কেল-ব্যালান্স-এর হ্যান্ডল ধরে নাড়াচাড়া করছিলাম, এমন সময় কেমন করে যেন হাতের থেকে লেভার-এর উজন-কাঠিটা মাপনযন্ত্রের পেটের ভিতর ঢুকে গেল। আমি অসহায়ভাবে হতভম্ব হয়ে ওটা তুলে আবার হাতলের সঙ্গে লাগাবার চেষ্টা করছি। এমন সময় স্টেশন-মাস্টার ব্যাপার দেখে, আমাকে ঐখানেই চুপ করে বসে থাকতে বললেন।৩ পরে এক পরিচিতজনের হস্তক্ষেপে বিপন্ন সন্ধিৎসু মোতাহার সেবারের মতো রেহাই পান।
এই কুষ্টিয়া হাইস্কুলেরই শিক্ষক ছিলেন জ্যোতীন্দ্রমোহন রায়। মোতাহার হোসেন যাঁকে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে তাঁর ‘শ্রেষ্ঠ শিক্ষক’ বলে রায় দিয়েছেন। এঁর কাছেই মোতাহার হোসেন নিচের ক্লাসে জ্যামিতি ও ওপরের ক্লাসে মেকানিকস বা ‘গতিবিজ্ঞান, স্থিতিবিজ্ঞান ও যন্ত্রবিজ্ঞান’ পড়েছেন। এঁর পড়ানোর ধরনটাই ছিল আলাদা। ক্লাসরুমের বাইরে নিয়ে গিয়ে হাতে-কলমে জ্যামিতি শেখাতেন। কখনও ছাত্রদের নিয়ে যেতেন পুরনো নীলকুঠিতে তার ব্যাসার্ধ মেপে বের করার জন্যে। আবার কখনও নিজে টিকেট কেটে ছাত্রদের সার্কাস দেখাতে নিয়ে যেতেন, বিনোদনের পাশাপাশি ‘ইনারশিয়া’ ও ‘সার্কুলার মোশন’ বোঝানোর জন্যে। প্রিয় ছাত্র মোতাহারকে তিনি যুক্তি দেখান, ‘তুই ত ওসব বইয়ে পড়েছিস; কিন্ত্ত চাক্ষুস দেখলে বিষয়টা আরও স্পষ্টভাবে তোর মনে বসে যাবে।’৪ কৃতজ্ঞ মোতাহার হোসেন বলেছেন :
এইভাবে জ্যোতীনবাবু কতভাবে কতদিকে আমাদের জ্ঞানবৃদ্ধির জন্য চিন্তা ও চেষ্টা করেছেন, তার অবধি নেই। আমার অঙ্কে বিশেষ পারদর্শিতা আছে দেখে, তিনি নিজের চেষ্টায় ‘মেকানিক্সে’র বই পড়ে আগের থেকেই পড়াবার জন্য প্রস্ত্তত হয়েছিলেন, আর হেডমাস্টারের কাছে বলেছিলেন, ‘মোতাহারের মতো এমন ছেলেকে যদি সবপযধহরপং পড়ানো না হয়, তাহলে আর কার জন্য এ বিষয় পড়ানো যাবে।’ এইভাবে যুক্তি দেখিয়ে উপযুক্ত যন্ত্রপাতি কিনে কুষ্টিয়া স্কুলেই বোধহয় পূর্ববাংলায় সর্বপ্রথমে মেকানিক্স পড়ানোর আয়োজন করা হয়।৫
জ্যোতীন্দ্রমোহনের হাতে-কলমে বিজ্ঞান শিক্ষা দেয়ার আরেকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন মোতাহার হোসেন। ছাত্রদের দিয়ে কাঠের গোল তক্তায় কাগজ সেঁটে ‘গণিতমিটার’ তৈরি করিয়ে তাদের আগ্রহকে উসকে দিতেন তিনি। মোতাহার হোসেনের তৈরি এই রকম একটি ‘গণিতমিটার’ তিনি বহুকাল সযত্নে সংরক্ষণ করেছিলেন। শুধু বিজ্ঞানশিক্ষা নয়,- সেই সঙ্গে বিজ্ঞানমনস্কতা, নীতি-নৈতিকতা আর মানবিকতার শিক্ষাও মোতাহার হোসেন তাঁর এই প্রিয় শিক্ষকের কাছ থেকেই পেয়েছিলেন। উত্তরকালে তাঁর ভেতরে যে বিজ্ঞানমানস গড়ে উঠেছিল, তার প্রথম পাঠ তিনি পেয়েছিলেন তাঁর এই স্মরণীয় স্কুলশিক্ষকের কাছ থেকেই।

৪.
অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু মোতাহার হোসেনের প্রত্যক্ষ শিক্ষক ছিলেন না- ছিলেন
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় সহকর্মী। কিন্ত্ত জিজ্ঞাসু মোতাহার হোসেন একজন শিক্ষার্থীর কৌতূহল নিয়েই তাঁর কাছে যেতেন এবং নিয়তই নিজের জ্ঞানতৃষ্ঞা মেটাতেন। কখনো গণিতের জটিল প্রশ্নের সমাধানের জন্যে তাঁর শরণাপন্ন হতেন, - আবার কখনোবা অধ্যাপক বসু নিজেও নানা ধরনের ‘কূট অঙ্কে’র সমাধান করতে দিয়ে তাঁকে ‘বাজিয়ে নিতেন’। এইভাবে মোতাহার হোসেন অধ্যাপক বসুর প্রিয় ও কাছের মানুষ হয়ে ওঠেন। এই সুবাদে তিনি নিজেকে সত্যেন বসুর ‘সবচেয়ে বড় ছাত্র’ বা ‘ছাত্রতম’ হিসেবে দাবি করেছেন।৬
অধ্যাপক বসুর প্রেরণাতেই মোতাহার হোসেনের পরিসংখ্যানবিদ্যা শেখা সম্ভব হয়। গণিতে মোতাহার হোসেনের আগ্রহ ও অধিকার লক্ষ্য করেই তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আর সেই তিরিশের দশকেই সত্যেন বসুর অনুসরণে তিনি বাংলা ভাষায় পদার্থবিদ্যা পড়াতে শুরু করেন। বিজ্ঞানের জটিল বিষয়কে ইংরেজি থেকে বাংলা ভাষায় রƒপান্তরের ঝোকও সৃষ্টি হয় অধ্যাপক বসুর উৎসাহে। এর ফলে সত্যেন বসুর ছঁধহঃঁস ঞযবড়ৎু সংক্রান্ত গবেষণা-নিবন্ধ বাংলায় তর্জমা করেন ‘ঝলকবাদ’ নাম দিয়ে এবং তা ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ছাপা হয়। এর পাশাপাশি তিনি অধ্যাপক বসুর আরো দু-একটি বিজ্ঞানবিষয়ক ইংরেজি-প্রবন্ধেরও ভাষান্তর করেন বাংলায়।
সত্যেন বসু মোতাহার হোসেনকে পরিসংখ্যান-বিদ্যা পড়তে পাঠিয়েছিলেন ভবিষ্যতের ভাবনা মাথায় রেখে। এ-প্রসঙ্গে মোতাহার হোসেন বলেছেন :
এর মধ্যেই তাঁর মাথায় এসে গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংখ্যাগণিত চালু করতে হবে। আর সে জন্য শিক্ষক সৃষ্টি করতে হবে। সত্যেনবাবুর স্নেহ ও অনুগ্রহেই আস্তে আস্তে আমার পাঠনের মোড় ফিরে গেল : পদার্থবিদ্যা থেকে পরিসংখ্যান বা তথ্যগণিতের দিকে। তিনি প্রথমে তথ্যগণিতকে অঙ্কশাস্ত্রের সঙ্গে সংযোজিত করে দিলেন। এর ফলে ১৯৩৯ সাল থেকে আমি তথ্যগণিত পড়াতে লাগলাম। এইভাবে কিছুদিন চলার পর তথ্যগণিতের একটা পুরো অনুষদ সৃষ্টি করা হল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটা বিষয়ে গর্ব করতে পারে; সে হচ্ছে, তথ্যগণিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ই.অ. ঐড়হড়ঁৎং ঈড়ঁৎংব খুলবার আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উক্ত অনার্স কোর্স খোলা হয়েছিল।৭
সত্যেন বসু শুধু মোতাহার হোসেনকে পরিসংখ্যান-বিদ্যা শিখতে পাঠিয়েছিলেন তাই নয়, ‘ইষড়পশ উবংরমহ’ সম্পর্কে গবেষণায়ও তাঁকে উৎসাহিত করে তোলেন, তাঁর পিএইচডি গবেষণাপত্রটিরও প্রয়োজনীয় সংশোধন করে দেন। তাঁর এই গবেষণা অভিসন্দর্ভের
অন্যতম পরীক্ষক ছিলেন বিশ্ববিশ্রুত পরিসংখ্যানবিদ স্যার রোনাল্ড ফিশার। তিনি মন্তব্য করেছিলেন :
ও ধস ঢ়ধৎঃরপঁষধৎষু ংঃৎঁপশ নু ঃযব বহঃবৎঢ়ৎরংব ংযড়হি নু গৎ. ঐংঁংধরহ. ওহ ড়ৎফবৎ ঃড় ংড়ষাব হবি ঃুঢ়বং ড়ভ ঢ়ৎড়নষবসং যব যধং ভড়ৎমবফ হবি সবঃযড়ফং নু ঃযব ধঢ়ঢ়ষরপধঃরড়হ ড়ভ যিরপয যব যধং ঢ়ৎড়াবফ ৎবংঁষঃং যিরপয ও যধফ ড়হষু মঁবংংবফ রিঃযড়ঃঁ নবরহম ধনষব ঃড় ঢ়ৎড়াব. ঐব যধং মড়হব সড়ৎব ফববঢ়ষু রহঃড় ঃযব ংঁনলবপঃ ঃযধহ ধহু ঢ়ৎবারড়ংঁ ৎিরঃবৎ.৮
মোতাহার হোসেন-উদ্ভাবিত পদ্ধতি সংখ্যাতত্ত্বশাস্ত্রে ‘ঐংঁংধরহং'ং ঈযধরহ জঁষব’ নামে স্বীকৃতি পেয়েছে। তাঁর এই সাফল্যের মূলে যে ছিলেন সত্যেন বসু সে-কথা কবুল করতে তিনি কখনও দ্বিধা করেননি- ‘এর আদিতে ছিল সত্যেনবাবুর অসীম স্নেহ।’ ৯

৫.
ডব্লিউএ জেনকিন্স-এর কাছে মোতাহার হোসেন নানা কারণে ঋণী। তিনি ছিলেন তাঁর পদার্থবিজ্ঞানের প্রিয় শিক্ষক। মেধাবী ও জিজ্ঞাসু ছাত্র হিসেবে মোতাহার জেনকিন্সের মনোযোগ কেড়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যাওয়ার সময় মোতাহার হোসেনের কথা বিশেষ করে সত্যেন বসুকে বলে যান। এর আগে ১৯২১-এর গোড়াতেই জেনকিন্সের কল্যাণে এমএ পরীক্ষার্থী মোতাহার হোসেন নব-প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদর্শক [উবসড়হংঃৎধঃড়ৎ] হিসেবে প্রবেশের সুযোগ লাভ করেন। কিছু পরে পূর্ণ শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। জেনকিন্সের আনুকূল্য তাঁর জীবন-বিকাশের পথ খুলে দেয়।

৬.
বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে মোতাহার হোসেনের নিজস্ব একটা পাঠদান পদ্ধতি ছিল। তিনি জটিল বিষয়কে সহজ করে মাতৃভাষায় বোঝানোর পক্ষপাতী ছিলেন। আর পাঠন-বিষয়ে উদাহরণ কিংবা সাদৃশ্য-বিবরণ আহরণ করতেন শিক্ষার্থীর অভিজ্ঞতার জগৎ থেকে। ফলে তিনি সহজেই হয়ে উঠেছিলেন ছাত্রপ্রিয় শিক্ষক। তাঁর পড়ানোর সহজ পদ্ধতির দরুনই নব-প্রবর্তিত পরিসংখ্যান-বিদ্যার শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় ভালো ফল করতে পারত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষকরাও এই সব ছাত্রের ‘গুছিয়ে জওয়াব’ লেখার প্রশংসা করতে কখনো কুণ্ঠিত হননি।১০
তাঁর পাঠন-প্রণালীর বৈশিষ্ট্য এবং শিক্ষার্থীর প্রতি গভীর মমতা ও মনোযোগের কারণে ছাত্রদের স্মৃতিতেও তিনি উজ্জ্বল হয়ে আছেন। জানা যায় :
ক্লাসের বাইরে, সন্ধ্যার পরেও আমরা পড়তে গেছি কাজী সায়েবের বাসায়। অসুস্থ অবস্থায় বিছানায় শুয়ে শুয়েও অস্পষ্ট কোন বিষয়কে তিনি স্পষ্ট করতে চেষ্টা করেছেন।’১১
কোনো যান্ত্রিক পদ্ধতি নয়, গতানুগতিক কোনো প্রণালীও নয়, তিনি পড়াতেন নিজস্ব এক ভঙ্গিতে। তাঁর শ্রেণীকক্ষে পড়ানোর ধরনটি ছিল এইরকম :
স্বকীয়তা ও অভিনবত্ব প্রকাশ পেত দৈনন্দিন ক্লাসরুমে তাঁর পড়ানোর মাঝেও। প্রায় সব সময়ই পরিসংখ্যান তত্ত্বের কোন একটা প্রতিপাদ্যের প্রমাণ বা কোনো একটা ধ্রুবাঙ্কের মান নির্ণয় করতেন সম্পূর্ণ নিজস্ব পদ্ধতিতে, যার সঙ্গে বইয়ের গতানুগতিক পদ্ধতির মিল খঁুজে পাওয়া যেত না। প্রচলিত ফরমুলার ধারে-কাছে না গিয়ে তিনি নিত্যনতুন ফরমুলা ও পদ্ধতি নিজেই উদ্ভাবন করতেন।
তিনি চাইতেন ছাত্ররা যেন মূল সূত্র (ভরৎংঃ ঢ়ৎরহপরঢ়ষব) থেকে যুক্তির প্রয়োগের দক্ষতা ও মানসিকতা অর্জন করতে পারে। বই থেকে না-বুঝে বা আধা বুঝে ক্লাসরুমে বা পরীক্ষার খাতায় উদগীর্ণ করা ছিল তাঁর অতি অপছন্দ। বইতে লেখা প্রচলিত পদ্ধতির বাইরে কোন একটা সমাধান করতে পারলে তিনি আনন্দিত হতেনঃ।১২

৭.
পরিসংখ্যান-বিদ্যা পঠন-পাঠনের ক্ষেত্রে মোতাহার হোসেন যেমন প্রবর্তকের দাবিদার, তেমনি বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রেও এ-দেশে তাঁর ভূমিকা পথিকৃতের। আমাদের বেশির ভাগ বিদ্বান-পণ্ডিতদের মধ্যে মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চা কিংবা পঠন-পাঠনের বিষয়ে একটা অনীহা বরাবরই লক্ষ্য করা গেছে। এ-ক্ষেত্রে পরিভাষাসহ নানা অজুহাত তাঁরা খাড়া করে থাকেন। মোতাহার হোসেন এ-সব বক্তব্যকে ‘ছেঁদো যুক্তি’ বলে বিবেচনা করতেন।
বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানশাস্ত্র পঠন-পাঠনে তাঁর আদর্শ ছিলেন অধ্যাপক সত্যেন বসু। তাঁর প্রেরণাতেই তিনি এ-বিষয়ে অগ্রসর হন। মোতাহার হোসেনের জবানিতেই জানা যায় :
১৯৩৬/৩৭ সাল থেকেই তিনি [অধ্যাপক সত্যেন বসু] বাংলা ভাষায় পদার্থবিদ্যা পড়াতেন। আমিও তাঁর পন্থা অনুসরণ করেছিলাম। এতে কোনও দিন অসুবিধা বোধ করিনি।১৩
সত্যেন বসুর পরামর্শে তিনি বাংলায় পদার্থবিদ্যার ব্যবহারিক শিক্ষার বইও লিখেছিলেন ছাত্রদের পরীক্ষণের উদ্দেশ্য’ ও ‘প্রক্রিয়া’ ভালোভাবে বোঝার জন্য।
মোতাহার হোসেন এরপর থেকে বরাবর বাংলা ভাষার মাধ্যমেই পড়িয়েছেন- প্রথমে পদার্থবিদ্যা, পরে পরিসংখ্যান। তাঁর কাছে পরিসংখ্যান পড়েছেন, এমন একজন এ-বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন :
বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার বিষয়ে তাঁর অগ্রণী ভূমিকা ছিল। ক্লাসের সব বই ইংরেজিতে হলেও তিনি পড়াতেন বাংলাতে অতি কঠিন তত্ত্বকে সহজ করে।১৪
পরবর্তীতে পুরোপুরি পরিসংখ্যানের শিক্ষক হলেও মোতাহার হোসেনকে তাঁর পূর্ব-বিষয় পদার্থবিদ্যার ক্লাসও কিছু কিছু নিতে হতো। এই পদার্থবিদ্যার এক প্রাক্তন ছাত্র তাঁর স্মৃতিচারণায় উল্লেখ করেছেন :
উচ্চ বিজ্ঞানের কথাও যে বাংলা ভাষায় সহজেই লেখা যায় এবং বলা যায়, এটা তাঁর [কাজী মোতাহার হোসেন] কাছ থেকেই প্রথম জানতে পারি।১৫

৮.
বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা, পঠন-পাঠন, বই লেখা ও তর্জমার বড় সমস্যা ও অন্তরায় যে কেবল পরিভাষার নয়, মানসিকতারও- এ-বিষয়ে মোতাহার হোসেন প্রথম থেকেই সচেতন ছিলেন। দেশভাগের পর শিক্ষা বোর্ড গণিতের পরিভাষা ও সৃষ্টির যে উদযোগ গ্রহণ করে, তাতে মোতাহার হোসেনের সক্রিয় ভূমিকা ছিল। তিনি সব সময় ‘সহজসাধ্য এবং বর্ণনামূলক পরিভাষারই পক্ষপাতী’ ছিলেন।১৬ পরিভাষার সমস্যা যে বিজ্ঞান-পঠন পাঠনের অন্তরায় হতে পারে না, সে বিষয়ে তিনি স্পষ্টই তাঁর ‘তথ্য-গণিত’ বইয়ের ভূমিকায় বলেছেন :
ঃ অনেকের মনেই অহেতুক সংশয় রহিয়াছে,-বাংলা ভাষার মাধ্যমে তথ্য-গণিতের মতো একটি বিষয় কেমন করিয়া শিখান যাইবে। পরিভাষা কোথায়? বাংলা ভাষার যে সমৃদ্ধি কোথায়, যাহাতে বহু পৃথক পৃথক প্রায় সমার্থক পারিভাষিক শব্দের ব্যঞ্জনা প্রকাশ করা যায়? কিন্ত্ত এই বলিয়া কি আরম্ভ করিতে হইবে না? আরম্ভ না করিলে কোথায় কোথায় জটিলতা রহিয়াছে, তাহা ধরা পড়িবে কেমন করিয়া, আর ধরা না পড়িলে অতিক্রমইবা করা যাইবে কিভাবে?
বিজ্ঞানের নানা বিষয়ের পরিভাষার ব্যাপারে তিনি সত্যেন বসুর পরামর্শ ও সহায়তা সবসময়ই পেয়েছেন।
তথ্য-গণিত বইয়ে মোতাহার হোসেন যে পরিভাষা উদ্ভাবন ও ব্যবহার করেছেন, তার অধিকাংশই সত্যেন বসু পছন্দ করেছিলেন, যে সামান্য কয়েকটি তিনি অনুমোদন করেননি, তার বিকল্প শব্দের ধারণাও তিনি দিয়েছিলেন।১৭
মোতাহার হোসেন নিজে বিজ্ঞান বিষয়ে বই-পুস্তক ও প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখে প্রমাণ করেন যে, মাতৃভাষায় বিজ্ঞানের মতো গুরুভার বিদ্যার চর্চা সহজেই হতে পারে। তিনি তথ্য-গণিত (১৯৬৯), গণিত শাস্ত্রের ইতিহাস (১৯৭০) ও আলোক-বিজ্ঞান (১ম খণ্ড, ১৯৭৫) রচনা করে যথাক্রমে পরিসংখ্যান, গণিত ও পদার্থবিদ্যা বংলায় পড়ানোর পাঠ্যপুস্তকের অভাব অনেকাংশে মিটিয়েছেন। এই বই তিনটি তার মাতৃভাষায় বিজ্ঞান-চিন্তারই ফসল। এক সময় তিনি স্যার রোনাল্ড ফিশারের পরিসংখ্যান সংক্রান্ত প্রামাণ্য গ্রন্থ ঝঃধঃরংঃরপধষ গবঃযড়ফ-এর বাংলা অনুবাদেও হাত দিয়েছিলেন, কিন্ত্ত শেষ পর্যন্ত নানা কারণে এই কাজটি সম্পন্ন হতে পারেনি।১৮
‘তথ্য-গণিতে’র ভূমিকায় তিনি উল্লেখ করেছেন :
ঃকলেজীয় শিক্ষা বাংলা ভাষার মাধ্যমে হইলে ছাত্রদের বুঝিবার সুবিধা হয় এবং অল্প প্রচেষ্টাতেই
বিষয়াদি আয়ত্ত হইতে পারেঃ। এ কথা বিজ্ঞান-শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
এই চেতনা থেকে যেমন তথ্য-গণিত কিংবা গণিত শাস্ত্রের ইতিহাস রচিত-অনুদিত হয়েছে, তেমনি আলোক-বিজ্ঞান ও। এই বইগুলো বাংলায় বিজ্ঞান বিষয়ক উচ্চতর পাঠ্যপুস্তক রচনার গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপই কেবল নয়, সেইসঙ্গে প্রেরণাসঞ্চারী উজ্জ্বল দৃষ্টান্তও।
১৯৭৪-এর ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে কাজী মোতাহার হোসেনকে সাম্মানিক ‘ডক্টর অব& সায়েন্স’ উপাধি প্রদান করা হয়। কোন বিশেষ আনুকূল্য কিংবা রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, তার অর্জন ও কৃতির পরিপ্রেক্ষিতেই এই সম্মান তাকে দেয়া হয়। এই সমাবর্তন সভায় তার পরিচিতি প্রসঙ্গে বলা হয়েছিল, ‘বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার যারা সূত্রপাত করেছেন, আপনি তাদের অন্যতম অগ্রণী’। -এই কথাটি আক্ষরিক অর্থেই তার জন্য সত্য ও প্রযোজ্য।
যৌবনের প্রথম পর্ব থেকেই বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে প্রবন্ধ-নিবন্ধ এবং পরবর্তী সময়ে বই লিখে মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চার জোরালো দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন মোতাহার হোসেন। এ ধারায় তিনি জগদীশচন্দ্র বসু, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, জগদানন্দ রায় কিংবা সত্যেন্দ্রনাথ বসুর যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে বিবেচিত হবেন।

৯.
কাজী মোতাহার হোসেন বিজ্ঞানের সাধনার পাশাপাশি সাহিত্য চর্চায়ও ছিলেন নিবেদিত। তাই তার সাহিত্য বিষয়ক মননশীল রচনায় নিরাবেগ-যুক্তিনিষ্ঠার বৈশিষ্ট্য এবং বিজ্ঞান বিষয়ক রচনায় সাহিত্যের সংবেদনা ও রসবোধ এবং সামাজিক কল্যাণ চিন্তার ছাপও পড়েছে। তিনি নিজেও একথা বলেছেন :
বিজ্ঞান যে সাহিত্য-রসে সঞ্জীবিত হয়ে প্রকাশিত হতে পারে এবং তা সমাজ ও জাতির মঙ্গল সাধনে শুভ ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে সেটা দেখানোও আমার উদ্দেশ্য।১৯
তার ‘কবি ও বৈজ্ঞানিক’ প্রবন্ধে তিনি বিজ্ঞান ও সাহিত্যের সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য নির্দেশের পাশাপাশি এদের পারস্পরিক সম্পর্ক-সূত্র আবিষ্কারের চেষ্টাও করেছেন। এ বিষয়ে তার বক্তব্য :
জগৎ ঃ কবি ও বৈজ্ঞানিক দুইজনের নিকটই কৃতজ্ঞ। বৈজ্ঞানিক না থাকলে কবির কল্পনা, খেয়াল হয়ে ধোঁয়ার মতো শূন্যে মিলিয়ে যেত, আর কবি-চিত্ত না থাকলে, বৈজ্ঞানিকের সাধনা পৃথিবীর ধুলা-মাটির মধ্যে মাথা কুটে মরত।২০
বিজ্ঞান ও সাহিত্যের মধ্যে একটা সমন্বয়ের চিন্তা তার মনে যে সক্রিয় ছিল তা বেশ বোঝা যায়।
মোতাহার হোসেনের বিজ্ঞানচিন্তা ছিল নিখাদ ও যুক্তিশাসিত। আমাদের দেশের অনেক মনীষীর মতো তিনি ধর্ম ও বিজ্ঞানের অযৌক্তিক সমন্বয় ও সরল সমীকরণে বিশ্বাসী ছিলেন না। তাই তিনি স্পষ্টই বলতে পারেন :
বিজ্ঞান ও যুক্তির সহিত সংঘর্ষে (অর্থাৎ জ্ঞানবিচার ও বুদ্ধির ক্রমিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে) ধর্মের আনুষঙ্গিক বিশ্বাসগুলোর যদি একটু পরিবর্তন হয়, তবে তাহা দূষণীয় নহে বরং সেইটিই প্রয়োজন।২১
সক্রেটিস ও গ্যালিলিওর সত্য-প্রকাশের চরম পরিণাম-ফলের দৃষ্টান্ত টেনে এ কথাও তিনি বলেছেন :
ঃ মত বা মত প্রকাশের স্বাধীনতা না থাকলে পৃথিবীতে জ্ঞানের উন্নতি মারা্তকভাবে ব্যাহত হতো। বর্বরতা স্থায়ী করার শ্রেষ্ঠ উপায় হচ্ছে নতুনের সন্ধান ছেড়ে দিয়ে স্থায়ী হয়ে পুরাতনকেই অাঁকড়ে বসে থাকা।২২
তাই, তার বিবেচনায় :
বিজ্ঞানের রাজ্যে এবং জীবনের সবক্ষেত্রেই মতের সহনশীলতা ও সংস্কারমুক্ত নিরাসক্ত বিচারই উন্নতির উপায়। বৈজ্ঞানিকের জ্ঞান উন্নয়নের পন্থা পরীক্ষামূলক।২৩
কেননা :
ঃ বৈজ্ঞানিক সচরাচর দৃশ্যমান জগতের প্রত্যেক বস্ত্ত ও ঘটনাকেই বিশেষভাবে পরখ করে দেখতে চান। তার কাছে ইন্দ্রিয়ের অগোচর বিষয়াদির প্রাধান্য নাই।২৪
বিশ্বাস নয়, নির্ভুল তথ্য আর অকাট্য যুক্তিই বিজ্ঞানের প্রধান অবলম্বন- সিদ্ধান্তের মূল উপকরণ তই রক্ষণশীল শাস্ত্রবিশ্বাসী সাধারণের চোখে বিজ্ঞানীর স্বরƒপ ভিন্নভাবে উদ&ঘাটিত হয়। সেই কারণে বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীকে ভুল বোঝার শিকারও হতে হয় অনেক সময়। কিন্ত্ত তা যে সঠিক মূল্যায়ন নয়, সে কথা উল্লেখ করে বলেছেন তিনি :
বৈজ্ঞানিককে সাধারণত বস্ত্ততান্ত্রিক নির্মম বিশ্লেষক ও নাস্তিক আখ্যা দেওয়া হইয়া থাকে। কিন্ত্ত বৈজ্ঞানিকের বস্ত্ত-তান্ত্রিকতার অর্থ সত্যনিষ্ঠা, সত্যকে বা বাস্তবকে ইন্দ্রিয়াদি ও যন্ত্রাদি সাহায্যে পরীক্ষা করিয়ে লওয়া এবং অন্ধবিশ্বাসের পরিবর্তে সুদৃঢ় জ্ঞানকে প্রতিষ্ঠিত করিবার চেষ্টা।২৫
কাজী মোতাহার হোসেনের বিজ্ঞানদৃষ্টির পেছনে নিছক জ্ঞানস্পৃহাই নয়, ছিল কল্যাণবুদ্ধি ও মানবতাবোধের ধারণাও। তিনি ১৯৩৯ সালে অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসুর একটি ইংরেজি প্রবন্ধের অনুবাদ করেন ‘সভ্যতা ও বিজ্ঞান’ নামে। এই প্রবন্ধটি তর্জমায় তিনি উদ্বুদ্ধ হন শুভবুদ্ধির প্রেরণায়। সত্যেন বসুর এই প্রবন্ধের বক্তব্য তাকে প্রাণিত করেছিল এবং এতে তার মতের প্রতিফলনও লক্ষ্য করেছিলেন। প্রবন্ধটির মূল বিষয় ছিল বিজ্ঞানের অপপ্রয়োগ,-এর নারকীয় ধ্বংসলীলা ও এর ফলে সভ্যতার সংকটের কথা এবং সর্বোপরি এই সমস্যা-সংকট উত্তরণের উপায়-নির্দেশ। এই প্রবন্ধে যে মানবিক আর্তি ও বিজ্ঞানের কল্যাণকর ইতিবাচক দিকের প্রশস্তি উচ্চারিত হয়েছে, তা মোতাহার হোসেনেরও চিন্তা-চেতনার অম্বিষ্ট ছিল।

১১.
মোতাহার হোসেন ছিলেন বুদ্ধির মুক্তি-আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা। ১৯২৬-এ ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় মুক্তবুদ্ধি-চর্চার প্রতিষ্ঠান ‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজ’। এই সংগঠনের বীজমন্ত্র ছিল- ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি যেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব;। সংস্কারমুক্ত, যুক্তিবাদী, প্রগতিশীল, কল্যাণমুখী সমাজগঠনই ছিল এর লক্ষ্য। ‘সাহিত্য-সমাজে’র এক বার্ষিক অধিবেশনের কার্যবিবরণী লিখতে গিয়ে মোতাহার হোসেন উল্লেখ করেছিলেন :
আমরা চক্ষু বুঁজিয়া পরের কথা শুনিতে চাই না, বা শুনিয়াই মানিয়া লইতে চই না;- আমরা চাই চোখ মেলিয়া দেখিতে সত্যকে জীবনে প্রকৃতভাবে অনুভব করিতে। আমরা কল্পনা ও ভক্তির মোহ-আবরণে সত্যকে ঢাকিয়া রাখিতে চাই না। আমরা চাই জ্ঞান-শিখা দ্বারা অসার সংস্কারকে ভস্মীভূত করিতে এবং সনাতন সত্যকে কুহেলিকা মুক্ত করিয়া ভাস্বর ও দীপ্তিমান করিতে।২৬
এই সংগঠনের চিন্তা-চেতনার আলোকেই মোতাহার হোসেনের মন-মানস মূলত গড়ে উঠেছিল। ‘সাহিত্যসমাজে’র এই যুক্তির-প্রজ্ঞার-বিজ্ঞানমনস্কতার প্রেরণাতেই চিরকাল পথ চলেছেন মোতাহার হোসেন।
সত্যের অনুরোধে এ কথা বলতেই হয় যে, আমাদের দেশে বিজ্ঞানচর্চা যারা করে থাকেন- বিজ্ঞান পঠন-পাঠনের সঙ্গে যারা যুক্ত, তাদের অনেকেই পুঁথি-শাসিত বিদ্বান এবং তারা সংস্কার, গোঁড়ামি, অন্ধবিশ্বাস, ভাবালুতা, রক্ষণশীলতা, শাস্ত্রের দাসত্ব থেকে পুরোপুরি মুক্ত নন। কিন্ত্ত মোতাহার হোসেন কখনও অন্ধবিশ্বাস বা প্রথার আনুগত্য করেননি, মানেননি সংস্কারের শাসন- ছিলেন যুক্তি, প্রগতি ও শ্রেয়চেতনার পক্ষে- পরিপূর্ণ বিজ্ঞানমনস্কতায় সমর্পিত সৃজনশীল এক বিজ্ঞানসাধক। কাজী মোতাহার হোসেনের সঙ্গে এখানেই অন্যদের মৌলিক ফারাক এবং এই বিবেচনাতেই তিনি একক ও অনন্য।
তথ্যনির্দেশ-
১. ‘লোকসাহিত্য পত্রিকা’, জুলাই-ডিসেম্বর ১৯৭৯। কাজী মোতাহার হোসেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’; পৃ. ৩৫
২. ‘লোকসাহিত্য পত্রিকা’, জানুয়ারি-ডিসেম্বর ১৯৮১। কাজী মোতাহার হোসেন, ‘আমার জীনব-দর্শনের অভ্যুদয় ও ক্রমবিকাশ’, পৃ. ১
৩. ‘লোকসাহিত্য পত্রিকা’, জানুয়ারি ১৯৭৫। কাজী মোতাহার হোসেন, ‘কুষ্টিয়ার স্মৃতিকথা’; পৃ. ১৭
৪. ঐ; পৃ. ২১
৫. ঐ; পৃ. ২২
৬. ‘লোকসাহিত্য পত্রিকা’, জানুয়ারি-ডিসেম্বর ১৯৮৪। কাজী মোতাহার হোসেন, ‘বিজ্ঞানচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বোসকে যেমন দেখিছি’; পৃ. ২-৩
৭. ঐ; পৃ. ৬-৭
৮. ‘লোকসাহিত্য পত্রিকা’, জুলাই-ডিসেম্বর ১৯৭৯। পূর্বোক্ত; পৃ. ৩৫
৯. ‘লোকসাহিত্য পত্রিকা’, জানুয়ারি-ডিসেম্বর ১৯৮৪। পূর্বোক্ত; পৃ. ১০
১০. ‘লোকসাহিত্য পত্রিকা’, জুলাই-ডিসেম্বর ১৯৭৯। পূর্বোক্ত; পৃ. ২৯
১১. সন&জীদা খাতুন সম্পাদিত, ‘কাজী মোতাহার হোসেন জন্মশতবর্ষ : আপনজনদের স্মৃতিকথা’; ঢাকা, ১৯৯৭। এম. ওবায়দুল্লাহ, ‘আমাদের কাজী সাহেব’; পৃ. ৩৩
১২. ঐ। কাজী ফজলুর রহমান, ‘কাজী মোতাহার হোসেন : একজন সম্পূর্ণ মানুষ’; পৃ. ৫১
১৩. ‘লোকসাহিত্য পত্রিকা’, জুলাই-ডিসেম্বর ১৯৮৪। পূর্বোক্ত; পৃ. ৭
১৪. ‘কাজী মোতাহার হোসেন জন্মশতবর্ষ : আপনজনদের স্মৃতিকথা’, পূর্বোক্ত। কাজী ফজলুর রহমান, পূর্বোক্ত; পৃ. ৫৪
১৫. ‘কাজী মোতাহার হোসেন জন্মশতবর্ষ : আপনজনদের স্মৃতিকথা’, পূর্বোক্ত। জামিল চৌধুরী, ‘অ্যাবসেন্ট মাইন্ডেড প্রফেসর’, পৃ. ৬১
১৬. আবুল আহসান চৌধুরী সম্পাদিত, ‘কাজী মোতাহার হোসেন রচনাবলী’, ৪র্থ খণ্ড, ঢাকা, জুন ১৯৯২; পৃ. ২০৬
১৭. ‘লোকসাহিত্য পত্রিকা’, জুলাই-ডিসেম্বর ১৯৮৪। পূর্বোক্ত; পৃ. ৮
১৮. ‘কাজী মোতাহার হোসেন জন্মশতবর্ষ : আপনজনদের স্মৃতিকথা’, পূর্বোক্ত। কাজী ফজলুর রহমান, পূর্বোক্ত; পৃ. ৫৪
১৯. কাজী মোতাহার হোসেন, ‘নির্বাচিত প্রবন্ধ’, ১ম খণ্ড, ঢাকা, জুন ১৯৭৬; ‘ভূমিকা’
২০. কাজী মোতাহার হোসেন, ‘সঞ্চরণ’, দ্বি-স : ঢাকা, ১৯৬৯; পৃ. ৫৪
২১. ঐ; পৃ. ১৭২
২২. আবদুল হক সম্পাদিত, ‘কাজী মোতাহার হোসেন রচনাবলী’, ২য় খণ্ড, ঢাকা, ডিসেম্বর ১৯৮৬; পৃ. ৮২-৮৩
২৩. ঐ; পৃ. ৮৩
২৪. ‘সঞ্চরণ’, পূর্বোক্ত; পৃ. ৪৭-৪৮
২৫. ঐ; পৃ. ২০৮
২৬. ‘শিখা’, ২য় বর্ষ : ১৯২৮; পৃ. ২২

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৩১ জুলাই, ২০০৯ (লেখার কারিগরি ত্রুটিগুলো পত্রিকায় প্রকাশিত পাতাতেও রয়েছে)

7 comments:

Anonymous said...

অসাধারন সব তথ্য নিয়ে লেখাটি আমার ভিষণ পছন্দ হয়েছে।লেখক কে অসংখ্য ধন্যবাদ। আমি পরিসংখ্যানের একজন ছাত্রী। এই লেখাটি কি আমি পরিসংখ্যান গ্রুপ(face book) এ লেখকের নাম ও source সহ publish করতে পারি?

Anonymous said...

Ofcourse. You can.- nirman

Anonymous said...

Thank you Nirman...is that your name? Actually I cant see the bloggers name here.

Md Shaiful islam Talukder said...

Thanks' for nice thing sharing.

shan said...

আমার খুব খারাপ লাগছে, তথ্য গণিত বইটি পড়তে না পারার জন্য,আমি দুবছর চেষ্টা করছি কিন্তু পাচ্ছি না

shan said...

আমার খুব খারাপ লাগছে, তথ্য গণিত বইটি পড়তে না পারার জন্য,আমি দুবছর চেষ্টা করছি কিন্তু পাচ্ছি না

Online Income said...

The estimate of writing your site post is very good .The simplest language you use when writing articles is appreciated .The information you give will prove to be of great value to me, I hope that. It is our wish that you continue to write great articles in such a future. Thanks for sharing this article. Thank you