বিজ্ঞান প্রজন্মের মুখোমুখি নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী

. Wednesday, November 5, 2008
  • Agregar a Technorati
  • Agregar a Del.icio.us
  • Agregar a DiggIt!
  • Agregar a Yahoo!
  • Agregar a Google
  • Agregar a Meneame
  • Agregar a Furl
  • Agregar a Reddit
  • Agregar a Magnolia
  • Agregar a Blinklist
  • Agregar a Blogmarks

প্রথম আলো পত্রিকার বিজ্ঞান প্রজন্ম বিভাগ সম্প্রতি বাংলাদেশ ঘুরে যাওয়া নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ড. আরনস্ট এর একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছে। সেখানে তিনি বলেছেন- "প্রয়োজন নতুন ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যার চালিকাশক্তি হবে বিজ্ঞান−ড. আরনস্ট"। সাক্ষাৎকারটি পাঠকের পাঠ সুবিধার্থে সম্পূর্ণ তুলে দিলাম।

বিজ্ঞান প্রজন্ম: কেমন লাগছে বাংলাদেশ?
ড. আরনস্ট: ভালো। এখানকার মানুষের মধ্যে খুব সুন্দর একটা প্রাণ আছে। ঢাকা শহরে ট্রাফিক জ্যাম অবশ্য চোখে পড়ছে। বেশ কিছু বহুতল ভবনও দেখলাম।
বিপ্র: আপনার গবেষণাকর্ম ও নোবেল বিজয় সম্পর্কে কিছু বলুন।
ড. আরনস্ট: আমার গবেষণার মূল বিষয় ছিল এনএমআর (নিউক্লিয়ার ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স)। পরে আমি ফিল্ড মডুলেশন টেকনিক, ফিল্ড ফ্রিকোয়েন্সি লক সিস্টেম, সলিড স্টেট এনএমআর, হাই রেজুলেশন এনএমআর স্পেকট্রোস্কোপি, স্পিন ডিফিউশন, অ্যাপ্লিকেশন টু ওয়ান ডাইমেনশনাল অর্গানিক কনডাক্টরস, ডাইনামিক্স ইন হাইড্রোজেন বন্ডেড কার্বক্সিলিক এসিড−এসব নিয়ে কাজ করেছি। যেসব পরমাণু নিউক্লিয়াসে বেজোড়সংখ্যক প্রোটন বা নিউট্রন বহন করে, তাদের স্বকীয় চৌম্বক ভ্রামক এবং কৌণিক ভরবেগ রয়েছে। এ ধরনের পদার্থের ওপর একটি নির্দিষ্ট চৌম্বকক্ষেত্র প্রয়োগ করলে নিউক্লিয়াসে অনুরণনের সৃষ্টি হয়। এটিই হলো এনএমআর।
এই এনএমআরের সুত্র ধরেই আবিষ্কৃত হয়েছে এমআরআই (ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং)। এমআরআইয়ের মাধ্যমে শরীরের যেকোনো অংশ বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঠিক অবস্থান, অবস্থা ও ক্রিয়াকর্ম পর্যবেক্ষণ করা যায়। বর্তমানে এমআরআই চিকিৎসাবিজ্ঞানের নিউরোলজি, কার্ডিওভাসকুলার, অনকোলজিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহূত হচ্ছে।
বিপ্র: এই এনএমআর নিয়ে ভবিষ্যতে আরও কী কী হতে পারে বলে ভাবছেন?
ড. আরনস্ট: এনএমআর এবং এমআরআই দিয়ে মানুষের মস্তিষ্কেকর সবকিছু জানা গেছে, তা কিন্তু নয়। তবে তত্ত্বীয় চিন্তা করলে এনএমআরবিজ্ঞান ব্যবহার করে আপনি মস্তিস্কের চুলচেরা পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করতে পারবেন। আপনি যখন হাত নাড়েন, পায়ের আঙ্গুল নাড়াচাড়া করেন, হাঁটা বা খাওয়াদাওয়া ইত্যাদি যা-ই হোক না কেন, তার সঙ্গে সঙ্গে মস্তিস্কে প্রচুর কাজ হয়, অনুরণন হয়, অনেক সংবেদনশীলতার প্রয়োজন বাড়ে, মস্তিষ্কপেশি ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে অনেক তথ্যের আদান-প্রদান ঘটতে থাকে। এসব তথ্য উদ্ধার করতে পারলে আমাদের চিকিৎসাবিজ্ঞান অনেক এগিয়ে যাবে।

বিপ্র: ভবিষ্যতে চিকিৎসাবিজ্ঞানের এই যে প্রত্যাশিত অগ্রগতি, তখন চিকিৎসাবিজ্ঞানের সার্বিক চেহারাটা কেমন দাঁড়াবে বলে আপনার মনে হয়?
ড. আরনস্ট: একটা জিনিস মনে রাখবেন, বিশ্ববিদ্যালয় বা ইনস্টিটিউটগুলোর গবেষণাগারে যা যা হয়, তার প্রতিফলন বাজারে বা সাধারণ মানুষের পর্যায়ে আসতে আসতে কখনো বা ১০ আবার কখনো ২০-৩০ বছর লেগে যায়। তেমনি চিকিৎসাবিজ্ঞানে নতুন অনেক তত্ত্ব, প্রযুক্তি, ওষুধ তৈরি হয়েছে, যেগুলো এখনো আসেনি, তবে আসবে। জেনেটিকসের সুফল চিকিৎসাবিজ্ঞানের মাধ্যমে এখনো সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছায়নি। তবে আশা করছি, শিগগিরই পৌঁছে যাবে। পাশাপাশি মেডিকেল পরীক্ষাগুলোর উন্নততর অনেক সংস্করণ ক্রমান্বয়ে আসতে থাকবে বলেই আমার বিশ্বাস। এক কথায় যদি বলি তাহলে বলব, যন্ত্র মানুষকে পড়তে পারবে, বুঝতে পারবে।
বিপ্র: আপনি কি নিজে এ অগ্রগতিতে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিচ্ছেন?
ড. আরনস্ট: নাহ্! আমার এখন বয়স হয়েছে। আমি বলা যায় অবসরে এখন। আগের মতো মস্তিষ্কক সৃষ্টিশীল নয়। তাই বলে আমি বসে নেই। চেষ্টা করছি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে, শিক্ষা-গবেষণায় সবার আগ্রহ তৈরি করতে, নতুন ধরনের সহনশীল ও কার্যকর অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রচলন করতে, বিশ্ব জলবায়ুর উষ্ণতা বৃদ্ধি, গ্রিনহাউস, পানিদুষণ, শব্দদুষণ প্রভৃতির বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধব্যবস্থা নেওয়ার জন্য গরিব-ধনী, ছোট-বড়, চাকুরে, সরকার−সবাইকে আহ্বান জানিয়ে চলেছি।
বিপ্র: একসময় বিজ্ঞান নিয়ে সরাসরি কাজ করেছেন। আর এখন বিজ্ঞানের জন্য জনসচেতনতা তৈরির কাজ করছেন। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
ড. আরনস্ট: বিশ্বের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থার দিকে তাকান। শেয়ারবাজারে ব্যাপকভাবে ধস নেমেছে, বিনিয়োগ বন্ধ। এমবিএওয়ালা আর কোম্পানির সিইওদের (চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার) বেতন বেড়েই চলছে, অথচ অন্যদের জীবন হয়েছে হতাশার। সমাজের অস্থিতিশীল করুণ এক প্রতিচ্ছবি দেখছি আমরা মুক্তবাজার অর্থনীতির মুখোশে ঢাকা করপোরেট যুগে। বাংলাদেশ যেহেতু ঘনবসতিপূর্ণ দেশ, তাই এখানে সামাজিক ও পরিবেশগত সমস্যা আরও প্রকটভাবে ধরা পড়ে। আমাদের এখন প্রয়োজন নতুন ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যার মূল নিয়ন্ত্রক হবে সরকার, চালিকাশক্তি হবে বিজ্ঞান। দেশের মানুষের প্রয়োজন বুঝে যেমন এগোতে হবে বিজ্ঞানকে; তেমনি বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্ককার ব্যবহার করে কীভাবে সহজ, সুন্দর জীবন যাপন করা যায়, সে চিন্তাও করতে হবে সবাইকে।
বিপ্র: এবার ব্যক্তিগত ও প্রত্যাশিত একটা প্রশ্ন−নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর অনুভুতি কেমন ছিল?
ড. আরনস্ট: এক কথায় অসাধারণ! নোবেল যেকোনো বিজ্ঞানীর জন্য স্বপ্ন। যেকোনো বিজ্ঞানীই নোবেল পাওয়ার স্বপ্ন মনের মধ্যে পুষে রাখে। আমিও রাখতাম। যখন ছাত্র ছিলাম, তখন মনের মধ্যে সব সময় নোবেল ও খ্যাতির আশা ছিল। অবশ্য গবেষণায় ঢোকার পর বুঝতে পারি, খ্যাতি নয়−সামাজিক দায়বদ্ধতা, সৃষ্টিশীলতা, বিজ্ঞানের আনন্দই আসল জিনিস। যখন গবেষণা করতাম, তখন সব সময় বলতাম, মানুষের জন্য কিছু একটা করব, কিছু একটা করব। পেরেছিও করতে, বুঝতেই পারছেন, সেই পারাটার পুরস্কার পাওয়ার আনন্দটা কতটা বিশাল, কতটা মোহনীয়।
বিপ্র: আচ্ছা, নোবেল পাওয়ার পর আপনার মধ্যে কোনো পরিবর্তন এসেছি কি?
ড. আরনস্ট: সত্যি বলছি, কোনো পরিবর্তন আসেনি। আমার খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-আশাক, হাঁটাচলা, চিন্তাভাবনা, পরিবার−সব আগের মতোই আছে। আমি এখনো টেলিভিশন দেখি না। তবে হ্যাঁ, আমার পরিবর্তন না আসুক, মানুষের এসেছে। আগে আমি কোথাও বক্তৃতা দিতে গেলে যেখানে শুন্য গ্যালারি থাকত, এখন সেখানে ভরাট গ্যালারি হয়ে যায়, গায়ে যেহেতু নোবেল বিজয়ী ট্যাগটা বসে গেছে!
বিপ্র: এবার বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছু বলুন।
ড. আরনস্ট: বাংলাদেশ খুব সুন্দর। আপনাদের অনেক জনশক্তি রয়েছে। তবে আমি যতটুকু জেনেছি, দক্ষতা ও প্রযুক্তির অভাব রয়েছে। আপনাদের উচিত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে তৃণমূল পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। প্রথমে প্রয়োজন একটি সুনির্দিষ্ট শিক্ষাব্যবস্থা। তার মূল লক্ষ্য থাকবে গবেষণা। গবেষণার মাধ্যমে দেশের জন্য প্রয়োজনীয় সমাধান দেবেন নবীন-প্রবীণ গবেষকেরা। যাঁরা গবেষণায় আসবেন না, তাঁদের জন্য প্রয়োজন চাকরি বা ব্যবসাসংক্রান্ত ভিত্তি। এ ভিত্তিটাও কিন্তু বিজ্ঞানভিত্তিক হওয়া চাই। বিজ্ঞানকে নিয়ে যেতে হবে গ্রামে। পাশাপাশি ভাবতে হবে দেশের সংরক্ষিত প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে। ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে প্রাকৃতিক সম্পদ ও নবায়নযোগ্য সম্পদের সমন্বিত ব্যবহার জরুরি। যানবাহন ও তাদের জ্বালানির সুন্দর সমাধান বের করতে হবে আপনাদের নিজেদেরই।
বিপ্র: আমরা এবার একটা বিশেষ বিষয়ে নজর দেব−পেটেন্ট ব্যবস্থার কারণে গরিব দেশগুলোয় অনেক প্রয়োজনীয় ওষুধের দাম বেড়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
ড. আরনস্ট: পেটেন্ট ব্যবস্থা অনেক আগে থেকে চলে আসছে। হঠাৎ করে নিশ্চয়ই এটি বন্ধ করে দেওয়া যাবে না। তবে এটির প্রয়োজনীয়তা, উপযোগিতা ও ব্যবহার নিয়ে বিশ্বকে ভাবতে হবে। পেটেন্ট ব্যবস্থার সবচেয়ে বাজে ব্যবহার করে চলেছে ওষুধ কোম্পানিগুলো। গরিব দেশগুলোর জন্য অবশ্যই ওষুধ কোম্পানিগুলোর ছাড় দেওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজনে ভিন্ন জায়গার জন্য ভিন্ন ধরনের বিপণনব্যবস্থার উদ্যোগ নিতে পারে ওষুধ কোম্পানিগুলো। সরকারকেও খেয়াল রাখতে হবে, দেশের মানুষের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোর দাম যেন বিলাসসামগ্রীর চেয়ে বেশি না হয়ে যায়। আপনাদের এখানে তো দুজন নোবেল বিজয়ী আছেন, তাঁরা নোবেলও পেয়েছেন অর্থনীতির ওপর ভিত্তি করে। তাহলে তো আপনাদের অর্থনীতিতে এ ধরনের সমস্যাগুলো থাকার কথা না!
বিপ্র: আপনার কাছে বিজ্ঞান প্রজন্মের শেষ প্রশ্ন বাংলাদেশের তরুণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে−তাদের জন্য আপনার কী বলার আছে?
ড. আরনস্ট: সত্যিকার অর্থে, তাদের জন্যই আমার সবচেয়ে বেশি বলার আছে। তাদের দিকেই আমরা সবাই তাকিয়ে আছি। তারা যা চাইবে, যা স্বপ্ন দেখবে, যা করবে, সেভাবেই চলবে আমাদের বিশ্ব। তারা যেন তাদের সামগ্রিক দায়বদ্ধতার কথা ভুলে না যায়। খ্যাতি, যশ−এগুলো পরে, প্রথমে তাকাতে হবে দেশের দিকে, সমাজের সাধারণ মানুষগুলোর দিকে। তাদের সমস্যা ও সমাধান নিয়ে ভাবতে হবে, দেশের উন্নতি নিয়ে ভাবতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচিত সরকার ও প্রতিষ্ঠানগুলোর যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করা, সৃষ্টিশীল করে গড়ে তোলা। এ জন্য প্রয়োজনে স্কুল পর্যায় থেকে শিশু-কিশোরদের নতুন, আনন্দদায়ক, যুগোপযোগী পাঠদানের ব্যবস্থা করতে হবে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় যেন একই ধারায় প্রবাহিত হয়, সেটা মাথায় রাখতে হবে। তরুণ গবেষকদের জন্য বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়-ইনস্টিটিউটগুলোয় গবেষণার উদ্যোগ নিতে হবে। বহির্বিশ্বের সঙ্গে শিক্ষক-শিক্ষার্থী আদান-প্রদানের মাধ্যমে সমন্বিত একটা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
বিপ্র: বাংলাদেশে আবার আসার ইচ্ছা আছে কি?
ড. আরনস্ট: অবশ্যই। দেশটা খুব সুন্দর। সুযোগ পেলে নিশ্চয়ই আরেকবার আসব।
বিপ্র: বিজ্ঞান প্রজন্মের পক্ষ থেকে আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
ড. আরনস্ট: আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ। বিজ্ঞান প্রজন্েনর পাঠকদের জন্য রইল আমার শুভেচ্ছা।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সুব্রত দেবনাথ
প্রথম আলো, ২ নভেম্বর, ২০০৮, লিংক

0 comments: