প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে ৫ লাখ নারী সারভাইক্যাল কারসিনোমায় বা জরায়ু মুখের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। তাদের মধ্যে শতকরা ৯৯.৭ ভাগের ক্যান্সার আক্রান্ত কোষে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের অস্তিত্ব ধরা পড়েছে। এই ভাইরাসের নির্দিষ্ট কিছু প্রকরণই ক্যান্সারের জন্য দায়ী। হ্যারল্ড জার হৌসেন প্রচলিত বিশ্বাসের দেয়াল ভেঙে প্রমাণ করেছেন, হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস জরায়ু ক্যান্সারের জন্য দায়ী। তার গবেষণায় বোঝা গেল, কীভাবে এটি ক্যান্সার সৃষ্টিতে সাহায্য করে। ফলে আবিষ্কৃত হয় এইচপিভির প্রতিষেধক টিকা। সুইডেনের ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউট জরায়ু ক্যান্সারের জন্য দায়ী হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস আবিষ্কারের জন্য হ্যারল্ড জার হৌসেনকে এবং একই সঙ্গে এইডস জীবাণু আবিষ্কারের জন্য যৌথভাবে ফ্রান্সিস বেয়ার সিনৌসি এবং লুক মন্টেনিয়ারকে ২০০৮-এ চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার দেওয়ার ঘোষণা দেয়।
ডা. হাসান শাহরিয়ার কল্লোল
কলেরা, ডায়রিয়া, টাইফয়েড বা ইনফ্লুয়েঞ্জা-মহামারীর দিন শেষ হয়েছে বলেই ধারণা চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের। যদিও এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা বা বার্ড ফ্লুর হুমকি এখনো পুরোপুরি কাটেনি। তবে সত্যিকারের যে মহামারীর হুমকি মানবজাতির সামনে মূর্তিমান আতঙ্কের মতো সাক্ষাৎ উপস্থিত তা হলো এইডস। ইতিমধ্যেই আফ্রিকা, ইউরোপ, এশিয়া, আমেরিকা আর অষ্ট্রেলিয়া- পাঁচ মহাদেশেই ছড়িয়ে পড়েছে রোগটি। আফ্রিকার দেশে দেশে বহু দশক ধরে চলা গৃহযুদ্ধেও এত লোক মারা যায়নি যত লোক মারা গেছে এইডসে। এইডস ছাড়াও আরেকটি ভাইরাস ঘটিত রোগ হচ্ছে সারভাইক্যাল ক্যান্সার। এটি জরায়ু মুখের এক ধরনের ক্যান্সার। প্রশ্ন উঠতে পারে ভাইরাস একটি জীবাণু। সুতরাং এটি দিয়ে জ্বর, সর্দি বা আমাশয়ের মতো জীবাণু ঘটিত রোগ হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ক্যান্সারের সঙ্গে এর সম্পর্ক কোথায়? খুবই যৌক্তিক প্রশ্ন। সে প্রশ্নের উত্তর আমরা পাব একটু পরই। বলে রাখা ভালো, ২০০৮ সালে চিকিৎসাবিদ্যা বা শরীরবিদ্যায় নোবেল বিজয়ের কাহিনী বুঝতে এটুকু ভূমিকার প্রয়োজন ছিল।
নোবেল ঘোষণা
গত ৬ অক্টোবর সুইডেনের ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউট সারভাইক্যাল ক্যান্সারের জন্য দায়ী হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস আবিষ্কারের জন্য হ্যারল্ড জার হৌসেনকে এবং একই সঙ্গে এইডসের জন্য দায়ী জীবাণু আবিষ্কারের জন্য যৌথভাবে ফ্রান্সিস বেয়ার সিনৌসি এবং লুক মন্টেনিয়ারকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার দেওয়ার ঘোষণা দেয়।
ঘোষণায় বলা হয়, হ্যারল্ড জার হৌসেন প্রচলিত বিশ্বাসের দেয়াল ভেঙে প্রমাণ করেছেন, হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (Human Papiloma Virus - HPV) সারভাইক্যাল ক্যান্সারের জন্য দায়ী। এটি মহিলাদের যত ধরনের ক্যান্সার হয় তার মধ্যে সংখ্যার হিসাবে দ্বিতীয় বৃহত্তম। তিনি বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন এইচপিভি-ডিএনএ টিউমারের ভেতর অনুৎপাদনশীল অবস্থায় থাকতে পারে। আর তাই সুনির্দিষ্টভাবে খুঁজলে সেখান থেকে ভাইরাসের ডিএনএ পাওয়া সম্ভব। গবেষণা করতে গিয়ে তিনি দেখলেন এইচপিভি একটি বিষম বর্গীয় ভাইরাস। এর নির্দিষ্ট কিছু প্রকরণই ক্যান্সারের জন্য দায়ী। তার এ আবিষ্কারের ফলে এইচপিভি বা হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের জীবনবৃত্তান্ত জানা গেল। বোঝা গেল কীভাবে এটি ক্যান্সার সৃষ্টিতে সাহায্য করে। ফলে আবিষ্কৃত হলো এইচপিভির প্রতিষেধক টিকা।
অন্যদিকে ফ্রান্সিস বেয়ার সিনৌসি এবং লুক মন্টেনিয়ার এইচআইভি বা হিউম্যান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাসের আবিষ্কর্তা। তারা এইডস রোগের প্রাথমিক পর্যায়ের রোগীদের ফুলে যাওয়া লসিকা গ্রন্থির লসিকা কোষ থেকে এবং শেষ পর্যায়ের এইডস আক্রান্তদের রক্তে এ ভাইরাসের সংখ্যা বৃদ্ধি খুঁজে বের করেন। তারা এ ভাইরাসটির অঙ্গসংস্থান, জৈবরাসায়নিক এবং প্রতিষেধক বিদ্যার ওপর ভিত্তি করে এ রেট্রো ভাইরাসটিকে মানবদেহের প্রথম জানা লেন্টি ভাইরাস হিসেবে চিহ্নিত করেন। এইচআইভি লসিকা কোষের ভেতর দ্রুত বংশবৃদ্ধি এবং পরবর্তী সময়ে কোষটিকে ধ্বংস করে (জীববিদ্যার ছাত্র বা পাঠক মাত্রেই জানেন, ভাইরাসের জীবিত কোষে বংশবৃদ্ধি ঘটে এবং তারপর ওই কোষের শেষ প্রাচীর বা কোষ আবরণী ভেদ করে বাইরে বেরিয়ে আসে, ফলে ওই কোষের মৃত্যু ঘটে)। রোপ্রতিরোধক ব্যবস্থা বা ইমিউন সিষ্টেমের কাজ মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে। এইডস রোগের সাম্প্রতিক রোগতত্ত্বটি বোঝা এবং এর এন্টিরেকটোভাইরাল চিকিৎসা পদ্ধতির পহৃর্বশর্তই ছিল এ আবিষ্কার।
হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস আবিষ্কারের কাহিনী
সারভাইক্যাল ক্যান্সার সংঘটনের প্রচলিত ধারণার বিপরীতে ১৯৭০ সালের দশকে হ্যারল্ড জার হৌসেন হিউমান প্যাপিলোমা ভাইরাসের ভূমিকা সম্পর্কিত বিষয়টি সামনে নিয়ে আসেন। তিনি ধারণা করেন, যদি কোনো ভাইরাস আদতেই ক্যান্সারের কারণ হয় তবে সেই টিউমার কোষের জিনোমের ভেতর ভাইরাসের ডিএনএ অঙ্গীভূত থাকবে। ফলে সুনির্দিষ্টভাবে খুঁজলে এইচপিভির বংশবৃদ্ধির জন্য সহায়ক জিন টিউমার কোষের ভেতরে শনাক্ত করা যাবে। এরপর থেকে দীর্ঘ এক দশক জার হৌসেন বিভিন্ন ধরনের এইচপিভি নিয়ে গবেষণা করেন। এ গবেষণাটি দুঃসাধ্য ছিল এ কারণেই যে, পোষক কোষের জিনোমে ভাইরাল ডিএনএর খুব সামান্যই অঙ্গীভূত থাকে। ১৯৮৩ সালে প্রথম তিনি একটি অনন্য এইচপিভি-ডিএনএ খুঁজে পান সারভাইক্যাল ক্যান্সারযুক্ত কোষের পরীক্ষায়। এভাবেই আবিষ্কৃত হয় ক্যান্সার সংঘটনকারী প্রথম এইচপিভি প্রকরণ- এইচপিভি ১৬। ১৯৮৪ সালে তিনি সারভাইক্যাল ক্যান্সার রোগীদের কোষ থেকে এইচপিভি ১৬ এবং এইচপিভি ১৮-এর ক্লোন করেন। পরবর্তী সময়ে নানা গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বজুড়ে সারভাইক্যাল ক্যান্সারের রোগীদের শতকরা ৭০ ভাগের ক্ষেত্রে এ দুটি প্রকরণ নিরবচ্ছিন্নভাবে পাওয়া গেছে।
এইচপিভি আবিষ্কারের গুরুত্ব
বিশ্বের জনস্বাস্থ্য সমস্যায় একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস। সব ধরনের ক্যান্সারের ভেতর শতকরা ৫ ভাগেরও বেশি হয় শুধু এ ভাইরাসের দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণের ফলে। যৌনবাহিত রোগের মধ্যে এটি সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়, যার শতকরা হার ৫০ থেকে ৮০ ভাগ। এ পর্যন্ত শতাধিক প্রকারের এইচপিভি ভাইরাসের মধ্যে ৪০টি প্রজননতন্ত্রকে আক্রমণ করে এবং তার মধ্যে ১৫টি মহিলাদের সারভাইক্যাল ক্যান্সারের ঝুঁকির মধ্যে ফেলে। এছাড়াও যোনিপথ, শিশু, মুখ ও অন্যান্য অঙ্গের কিছু ক্যান্সারেও এই ভাইরাস পাওয়া গেছে। প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে ৫ লাখ নারী সারভাইক্যাল ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। তাদের মধ্যে শতকরা ৯৯.৭ ভাগের ক্যান্সার আক্রান্ত কোষে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের অস্থিত্ব ধরা পড়েছে।
হ্যারল্ড জার হৌসেন এইচপিভির অভিনব বৈশিষ্ট্যগুলো ব্যাখ্যা করেন, যার ফলে ভাইরাস সংক্রমণজনিত ক্যান্সার রোগের সৃষ্টির প্রক্রিয়া, ক্যান্সার সংক্রমণের পূর্বশর্ত হিসেবে ভাইরাসের দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমণ এবং কোষের পরিবর্তনে এর প্রভাবের বিষয়গুলো বোঝা সহজ হয়। তিনি বিজ্ঞানীদের কাছে এইচপিভি ১৬ এবং ১৮ সহজলভ্য করেন।
ফলে আবিষ্কার হয় প্রতিষেধক, যা ঝুঁকিপূর্ণ এইচপিভি ১৬ এবং ১৮-এর সংক্রমণ থেকে শতকরা ৯৫ ভাগেরও বেশি ক্ষেত্রে সুরক্ষা দেয়। এছাড়া এ প্রতিষেধকগুলো সার্জারির প্রয়োজন কমায় এবং বিশ্বব্যাপী সারভাইক্যাল ক্যান্সারের প্রকোপ কমাতে ভূমিকা রাখছে।
সমকাল, ২৪ অক্টোবর, ২০০৮ এর কালস্রোত পাতায় প্রকাশিত
২০০৮ সালের সেরা ১০টি বৈজ্ঞানিক ঘটনা -০২
-
নতুন জগৎ:
বিজ্ঞানীরা সবসময় এমন ধারণা করতেন যে সূর্য ছাড়াও এমন নক্ষত্র আছে যার চারপাশে
পৃথিবীর মতো গ্রহ নিয়মিত আবর্তিত হয়। কিন্তু ১৯৯৫ সালের আগে এরকম বহির্জা...
15 years ago
0 comments:
Post a Comment