মৌমাছি কি বিলুপ্ত হয়ে যাবে?

. Friday, March 21, 2008
  • Agregar a Technorati
  • Agregar a Del.icio.us
  • Agregar a DiggIt!
  • Agregar a Yahoo!
  • Agregar a Google
  • Agregar a Meneame
  • Agregar a Furl
  • Agregar a Reddit
  • Agregar a Magnolia
  • Agregar a Blinklist
  • Agregar a Blogmarks

মুশফিকুর রহমান

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সংবাদমাধ্যমে এখন অন্যতম আলোচিত বিষয় মৌমাছির বিলুপ্তি-আশঙ্কা!
আমরা যখন পরিবেশ নিয়ে আলোচনা করি, তখন একপশলা বৃষ্টিতে শহর ও লোকালয়গুলোর বসবাস অযোগ্য হয়ে ওঠা; বৃষ্টি বিলম্বিত হলে পরিষ্ককার পানির জন্য হাহাকার, বর্ষায় নর্দমা উপচে পথে এবং কখনো ঘরবাড়িতে উঠে আসা থেকে শুরু করে পাহাড়ধসে প্রাণহানি, নদীর দুই কুল উপচে ও পাড় ভেঙে মানুষের জীবন ও জীবিকা বিপন্ন করা, সাইক্লোন-জলোচ্ছ্বাস, সম্প্রতি অতি আলোচিত বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও তার আশঙ্কায় বাংলাদেশের কতভাগ স্কীত সমুদ্রের জলে ডুবে যাবে পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে যায়।

দুরবর্তী মনে হলেও বিশ্বজুড়ে জ্বালানির অব্যাহত ও অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং মানহীন জ্বালানি ও ত্রুটিপূর্ণ যানবাহনের নিয়ন্ত্রণহীন ব্যবহারে শহরাঞ্চলে বায়ুদুষণ, জীবনযাত্রা বিপন্ন হওয়ার বিষয়গুলো আমাদের অন্যতম আশঙ্কার উপাদান।
পরিবেশের অন্য বিষয়গুলোও আলোচনায় আসে, যেমন বন উজাড়, পানিদুষণ, প্রজাতি ও জীববৈচিত্র্যের বিলুপ্তি বা বিপন্নতার বিষয়। সাম্প্রতিক সময়ে জ্বালানি ও খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধির অব্যাহত চাপে মানুষের দিশেহারা হওয়ার অবস্থা। বিষয়টি অবাক করার মতো শোনালেও সত্যি যে জ্বালানি ও খাদ্যসংকটের সম্পর্ক নিবিড়। আবার দুষণ হ্রাস, বিশ্বের উষ্ণায়ন থেকে খানিক প্রশাসনের তাগিদে যে পরিবেশবান্ধব বায়োফুয়েল উৎপাদনের বর্ধিত উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তাতে খাদ্যসংকট ও জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি ঘটছে। আবার জ্বালানি ও জমি দুর্লভ হয়ে ওঠায় খাদ্যশস্যও দুর্লভ ও দুর্মুল্য হচ্ছে। এ দিক দিয়ে দেখলে পরিবেশ রক্ষার উদ্যোগ খাদ্য ও জ্বালানি উভয়কে ব্যয়বহুল করে তুলছে। আবার বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত পরিবেশগত অভিঘাত এত প্রবল আশঙ্কার বিষয় হয়ে উঠেছে যে জীবাশ্ম জ্বালানির উত্তম বিকল্প অনুসন্ধান অবধারিত।

আমাদের হয়েছে ত্রিশঙ্কু অবস্থা। বেশি মানুষ আর স্বল্প সম্পদের মধ্যে দুর্বল ব্যবস্থাপনায় প্রতিমুহুর্তেই আমাদের টিকে থাকার সংগ্রাম করতে হচ্ছে। পৃথিবীর যে প্রান্তেই পরিবেশের যে বিপর্যয় দেখা দিক আমাদের তাতে নিষ্ককৃতি নেই। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপে মৌমাছিগুলো কেন দ্রুত বিলুপ্ত হচ্ছে, তাও আমাদের ভাবনার বিষয় না হওয়ার সুযোগ নেই। কেন?

মৌমাছি আমাদের পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও তার বিকাশের অন্যতম প্রধান সহায়ক শক্তি। অন্তত এক লাখ ৩০ হাজার উদ্ভিদের পরাগায়ণ সরাসরি মৌমাছির ওপর নির্ভরশীল। একটি মৌচাকে যে মৌমাছি বাস করে, তার চারপাশে ৪০০ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে যত ফুল ফোটে, এক দিনে সেগুলোতে ঘুরে ঘুরে মধু সংগ্রহ ও পরাগায়ণ করতে সাহায্য করে ওইসব মৌমাছি। আমাদের চারপাশে যত ফুল ফোটে, ফল ধরে, শস্য, সবজি চাষ হয়, মৌমাছি সেসব ক্ষেত ও বাগানে না এলে কী হবে ভাবা যায়? যদি পরাগায়ণ বিঘ্নিত হয় তাহলে আমরাই কেবল ফল-মূল-শস্য থেকে বঞ্চিত হব তাই নয়, পুরো উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের খাদ্য ও জীবনচক্র হয়ে উঠবে বিপন্ন। মৌমাছি নিয়ে যাঁরা গবেষণা করছেন, তাঁরা তো আশঙ্কা করছেন−মৌমাছির বিলুপ্তিকে কয়েক বছরের মধ্যে অনুসরণ করবে মানুষ ও অন্যান্য প্রজাতি!

মৌমাছি যে মধু সংগ্রহ ও উৎপাদন করে তা কেবল পুষ্টি ও ঔষধিগুণে সমৃদ্ধ নয়; মৌমাছির খাবার ও শক্তি জোগান দেওয়ার উপাদানও বটে। সুতরাং মৌমাছি বিলুপ্ত হলে বা আশঙ্কাজনকভাবে এর সংখ্যা কমে গেলে আমাদের আশঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এক বা একাধিক কারণে মৌমাছির সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের মৌচাষি ও গবেষকদের অনেকেই কয়েক বছর ধরে লক্ষ করছেন মৌমাছির আশঙ্কাজনক হারে বিলুপ্তি। তাদের চোখে পড়েছে অত্যন্ত সংগত কারণেই অদ্ভুত ঘটনা−মৌচাক ছেড়ে উড়ে যাওয়া মৌমাছিগুলো অজানা কারণে ওই মৌচাকগুলোতে আর ফিরে আসছে না। সুযোগসন্ধানী অন্য মৌমাছির ঝাঁক সেগুলো সংগ্রহে উৎসাহ দেখাচ্ছে না। এতে মৌচাষিদের আশঙ্কা−হয়তো কোনো অজানা রোগ বা বিষক্রিয়া মৌমাছি ও তাদের সংগৃহীত মধু-মৌচাক আক্রান্ত করছে। এমন নয় যে মৌচাক ছেড়ে যাওয়া মৌমাছিগুলোর গণমৃত্য ও মৃতদেহ কোথাও ছড়িয়ে থাকা অবস্থায় কেউ খুঁজে পাচ্ছে। হয়তো মৌমাছির বিচরণ এলাকার বিস্তৃতি, ক্ষুদ্র ও দ্রুত ধ্বংস হওয়ার মতো দেহ এ ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা।

গবেষকেরা লক্ষ করেছেন যে ১৯৭১ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় অর্ধেক মৌচাক বিলুপ্ত হয়েছে। সাগর পাড়ি দিয়ে আমেরিকার মৌমাছিগুলো ইউরোপে তাদের সমস্যা ছড়িয়ে দিয়েছে এমন ধারণার কোনো প্রমাণ নেই। কিন্তু স্পেন, ফ্রান্স, ক্রোয়েশিয়া, পোল্যান্ড সুইজারল্যান্ড, ইতালি, গ্রিস, পর্তুগাল ও জার্মানিতে মৌমাছি ও মৌচাক বিলুপ্তির ব্যাপক প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ইউরোপে ছড়িয়ে পড়া মৌমাছির এই আকস্িনক মড়ক কেবল মৌচাষিদের নয়, পরিবেশ ও কৃষি, জীববৈচিত্র্যের সংকট হিসেবেই চিহ্নিত করা হচ্ছে।
জার্মান বিজ্ঞানী ও কৃষিবিদেরা মৌমাছিগুলোর এই ব্যাপক মড়ককে মধু উৎপাদন শিল্পের সঙ্গে এইডস মহামারির তুলনা করছেন। মৌচাক বিলুপ্তির এই ব্যাপক বিস্তৃতি-প্রবণতাকে নাম দেওয়া হয়েছে সিসিডি বা কলোনি কলাপস ডিসঅর্ডার। মৌমাছি ও মৌচাক বিলুপ্তির এই ছড়িয়ে পড়া আতঙ্কের কারণ অনুসন্ধানে নানামুখী গবেষণাও শুরু হয়েছে। এ জন্য শস্য ও কৃষি খাতে ব্যাপক মাত্রায় কীটনাশক ব্যবহারকে কেউ কেউ দোষারোপ করছে। ২০০৪ সালে মৌচাষিদের দাবির মুখে ফ্রান্সে ‘ফিপ্রোনিল’ নামের এক ধরনের কীটনাশক নিষিদ্ধ করা হয়। যদিও উৎপাদক প্রতিষ্ঠান এই কীটনাশকের সঙ্গে মৌমাছি ধ্বংসের সম্পর্ক অস্বীকার করেছে।
বিভিন্ন অনুমানের মধ্যে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বা জেনেটিক্যালি মডিফায়েড ফুডের (জিএম ফুড) বিস্তৃতিকেও অনেকে দায়ী করার চেষ্টা করছেন। আরও একধাপ এগিয়ে অনেক গবেষক ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া মোবাইল-টেলিফোন প্রযুক্তিকে সম্পর্কিত করছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন গবেষণায় মোবাইল ফোনের তেজস্ক্রিয় বিকিরণকে মৌমাছির ব্যাপক মড়কের সঙ্গে সম্পর্কিত করা হচ্ছে। গবেষকদের একদল লক্ষ করেছে যে মোবাইল ফোনের টাওয়ারের আশপাশে মৌমাছি আসতে চায় না। ফিনল্যান্ডের সরকারি এক গবেষণায় পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, নিয়মিত ১০ বছরের বেশি সময় ধরে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের ব্রেন টিউমার হওয়ার আশঙ্কা ৪০ শতাংশ বেশি বলে চিহ্নিত হয়েছে। মৌমাছি ছড়িয়ে পড়া ব্যাপক মড়কের সঙ্গে এই গবেষণা ফলাফলকেও সম্পৃক্ত করা হচ্ছে। যদিও মোবাইল ফোন কোম্পানি এ সম্পর্কিত গবেষণা ও বিজ্ঞানীদের আশঙ্কাকে অমূলক বলতেই পছন্দ করেন।

বিখ্যাত লানডাও বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. জোসেন কুন পরিচালিত গবেষণা অনুযায়ী মৌমাছি মোবাইল ফোন চালু রাখলে নিকটবর্তী মৌচাকে ফিরতে অপছন্দ করে বলে তথ্য দিয়েছেন। বিজ্ঞানীদের গবেষণার বর্তমান পর্যায়ে বিশ্বজুড়ে দ্রুত মৌমাছি কেন বিলুপ্ত হচ্ছে তার স্পষ্ট উত্তর না পাওয়া গেলেও এ কথা নিশ্চিত যে মৌমাছি ও মৌচাক দ্রুত বিলুপ্ত হচ্ছে। তা ছাড়া মৌমাছির এই মড়ক দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে দেশ থেকে দেশান্তরে। একক কোনো কারণ, নাকি অনেক কারণের মিলিত ফল হিসেবে এই মৌমাছির মড়ক, তা এক্ষনি বলা কঠিন। তবে কৃষিতে ব্যাপকভাবে ব্যবহূত কীটনাশক, প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহারের আধিক্য, মাইক্রোওয়েভ ও মোবাইল ফোন প্রযুক্তির ব্যাপক বিস্তৃতি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও কৃষি এবং বনায়নে মনোকালচার (একই গাছ বা ফসলের চাষ) এ জন্য দায়ী বলে অনুমান করা হচ্ছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, আমাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জ্ঞান এখনো অনেক প্রশ্নেরই জবাব দিতে সমর্থ হয়নি। আবার প্রযুক্তির বিকাশ ও বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে অনেক নতুন সমস্যাও হাজির হচ্ছে। সে সমস্যাগুলো কেবল গবেষণাগার বা জ্ঞান জিজ্ঞাসার রহস্য নয়, এর সঙ্গে যুক্ত পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য এবং সরাসরি আমাদের খাদ্য ও জীবনের নিরাপত্তা।

মুশফিকুর রহমান: খনিবিশেষজ্ঞ ও পরিবেশ বিষয়ক লেখক।

0 comments: